কেমন করে যেন পোডটা আরো ভিতরে চলে গেল, সেখানে এক নতুন বিস্ময় ওৎ পেতে আছে। সামনে এক বিরাট লালচে নক্ষত্র। রেড জায়ান্ট স্টার। এর উজ্জ্বলতা এতই স্নান যে ভোলা চোখে তাকাতেও কোনো সমস্যা হয় না। এখান থেকে পৃথিবীর আকাশের চাঁদের চেয়েও বড় দেখাচ্ছে। এর দীপ্তিটা জ্বলন্ত কয়লার চেয়ে বেশি নয়। লালের গায়ে হলুদের চিকণ রেখা। সরু দাগগুলো যে হাজার মাইলের খরস্রোতা আগুন-নদী তা বোঝাই যায় না। ওরা মরতে বসা সূর্যের বুকে হারিয়ে যাবার আগে যথাসম্ভব চলাচল করে নিচ্ছে।
মৃতপ্রায় শব্দটা মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক থাকলেও সূর্যের ক্ষেত্রে যেন মানায় না। এ সূর্য তার যৌবনের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসে দ্যুতি হারিয়ে বসেছে। তার জ্যোতির্ময় বেগুনী, নীল আর সবুজ বর্ণালীর শত শত কোটি বছরের যুগ শেষ করে শান্ত সৌম্য দীপ্ত রূপ নিয়েছে আরো অনাগত ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। এবং বিগত সময়ের তুলনায় অনাগত সময় আরো আরো বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে আসবে। তার দুর্দম যৌবনের চেয়ে সৌম্য-তারুণ্য চলবে হাজারগুণ বেশি সময় ধরে।
এখন আর বোম্যান কোনো নিয়ন্ত্রণ অনুভব করছে না। কিন্তু সে জানে, যে শক্তি তাকে এখানে টেনে এনেছে সেটা তার বজ্রমুষ্ঠিকে একটুও শিথিল করেনি। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যেন তার সামনে হাস্যকর ও মূল্যহীন।
সে বোঝার চেষ্টা করছে কোনো অবশ্যম্ভাবী নিয়তি এবার তাকে টানবে। সম্ভবত এই সূর্যের কোনো কক্ষপথ ধরে কোনো গ্রহ ঘুরছে, সেখানে তাকে হয়তো নিয়ে যাওয়া হবে। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সে সূর্যের প্রান্তসীমায় অবাক করা কিছু দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়।
পেছনে, একটা সাদা জ্যোতির উদয় হয়েছে, এগিয়ে আসছে দ্রুত। উঠে আসছে এ সূর্যের দিকে। সেটাই কি সময় থেকে সময়ে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ঘুরে বেড়ায়? পরে বুঝতে পারে, না। সেটাও এক নক্ষত্র, আকারে শুধু ছোট আর হাজারগুণ উজ্জ্বল।
সে নিজের ভাবনা দেখে নিজেই হেসে ওঠে। সূর্যোদয়ে সে বিমোহিত… সূর্যোদয়, একটা সূর্যের উপর!
নীলচে আলোর এক ছোট্ট গোলক সেটা। ছোট সূর্যটা খুব দ্রুত সঙ্গীর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় মনে হচ্ছে। কিন্তু এই সূর্যের কি কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না? ভাবতে ভাবতেই সে দেখতে পায় প্রতিক্রিয়ার রূপ। ছোট দানবের শক্তির টানে কাবু হয়ে বড় নক্ষত্রের গা থেকে হাজার হাজার মাইল লম্বা আগুনের শিখা উঠে যাচ্ছে উপরদিকে। আগুনের জোয়ার!
সেই ছোট্টটা নিশ্চয়ই কোনো হোয়াইট ডোয়ার্ফ। এরা আকারে বড়জোর পৃথিবীর সমান, কিন্তু ভরে কোটিগুণ বড়। এমন বেখাপ্পা সৌর জুটি আসলে মোটেও বেখাপ্পা নয়। কিন্তু বোম্যান কোনোদিন এমন দৃশ্য দেখার বেখাপ্পা কল্পনা করেনি।
এরমধ্যেই সাদা বামন তার সাথীর অর্ধেকটা পার করে ফেলেছে। সম্ভবত কয়েক মিনিটে একবার পাক খায় পুরো এলাকাটা। অবশেষে বোম্যান বুঝতে পারে যে সেও ভেসে চলেছে। কারণ অন্তরালের এক ঝকঝকে নক্ষত্র এর মধ্যেই সামনে আসতে আসতে অনেকটা স্পষ্ট বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নিশ্চয়ই এখানে সে যাচ্ছে।
কিন্তু সেটা কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ নয়।
সেটা এক ধাতব জিনিস। কৃত্রিম উপগ্রহের মতো এর নাম দেয়া যায় কৃত্রিম গ্রহ। বিশাল তার আকৃতি, সারফেসে বসে থাকা শহরের সমান একেকটা মেশিন দেখেও সে আঁতকে ওঠে। সে যতবার আঁতকে উঠেছে গত কয়েক মাসে ততবার বোধহয় কোনো মানুষ চমকায় না এক জীবনে।
বড়গুলোর প্রতিটির চারপাশে একরের পর একর এলাকাজুড়ে ছোট মেশিনের রাজত্ব। সেগুলোও সমান নয়। কোনো কোনোটা দেখা যায় না আবার কোনোটা চোখে ধাক্কা দেয়। সে এমন কয়েকটা এলাকা পেরুনোর পর বুঝতে পারে যে ছোট মেশিনগুলোর প্রতিটি অঞ্চল একেকটি মহাকাশ নৌবহর। আর গোলাকার ধাতব জিনিসটা আর কিছু নয়, মহাজাগতিক পার্কিং লট।
যেহেতু পুরো পরিবেশ এবং এর প্রতিটি অংশই তার অচেনা সেহেতু সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারল না নিচের দৃশ্যটা কত বড়। সেখানে কোনো মহাকাশ নৌবহরে ডিসকভারিকে ঢুকিয়ে দিয়ে উপরে উঠে এলে বোঝা যেত। নিচের ওগুলো কত বর্ণের, গোত্রের আর আকৃতির তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। কোনোটা স্বচ্ছ, কোনোটা আলোকদাত্রী, কেউ লম্বা, কোনোটা পুরোপুরি চাকতির মতো, কোনোটা আকার বদলাচ্ছে স্থির থেকেই…মাথা খারাপ করা দৃশ্য।
এ নিশ্চয়ই কোনো মহাজাগতিক অর্থনৈতিক মিলনমেলা।
কিংবা মিলনমেলা ছিল কয়েক মিলিয়ন বছর আগে। কারণ জীবনের কোনো নিদর্শনই সে দেখতে পায়নি অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও। বরং মহাকালের হাজারো উল্কা নির্দ্বিধায় এর উপর পড়েছে বছরের পর বছর। এত বিশাল জিনিসটা কেন অকেজো পড়ে আছে তা আর সে জানে না। যা জানে তা হল সামনের ঐ ধাতব গড়নটা এখন শুধুই মহাজাগতিক আস্তাকুঁড়।
সে কত সহস্র বছরের ব্যবধানে এসেছে তাও জানে না। এই মহা সম্মেলন আর নির্মাতাদের দেখতে পেল না শুধু সময়ের ব্যবধানের জন্য। একটু আঁৎকে ওঠে সে কথাটা ভেবে। তার মন অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার খোঁজে আঁকুপাকু করছিল এতদিন।
সে কোনো পুরনো ফাঁদে আটকা পড়ে যায়নিতো? লাখো বছর আগে স্টেশন গ্রহের যে গর্তে ও পড়ে যায় সেই পথ ধরে যারা যেত তারা হয়তো এখানেই নিজেদের নিয়ে আসতে চেষ্টা করত। সেই পথ একই কাজ করে যাচ্ছে আজো, তারাই শুধু নেই।