এমন সময় সে পরিত্যক্ত জিনিসটার কথা ভুলে গেল সামনে আরো একটা কিছু আসতে দেখে।
প্রথমে জিনিসটাকে সমতল চাকতির মতো লেগেছিল, পরে বুঝতে পারে সেটা সরাসরি তার দিকে আসাতেই এমন দেখা যায়। কাছে এসে পাশ কাটিয়ে গেলে সে বুঝতে পারে যে জিনিসটা লাটিমের মতো আর কয়েকশো ফুট লম্বা। এও বোধহয় কোনো শিপ। ঘুরতে ঘুরতে এগোয় বলে তেমন কিছু বোঝা যায়নি।
জিনিসটা অনেক দূরে চলে যাবার আগ পর্যন্ত সে চোখ ফেরাতে পারে না। তারপর বুঝতে পারে যদি তার চোখ ঠিক দেখে থাকে তো এর স্রষ্টারা মানুষের পরিচিত একটা ব্যাপারের সাথে মিল রেখেছে। তাদের জাহাজ বানানোর উপাদানটা পরিচিত হলেও সহজলভ্য নয়। স্বর্ণ।
বোম্যান আবারো তাকায় রিয়ারভিউ মিররে। সেটা তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলে গেছে। সে তো উপেক্ষা করতে পারে না। নিচের বিরাট গ্রহের লক্ষ প্রবেশপথের কোনো একটা দিয়ে শিপটা ঢুকে গেল ভিতরে। আর কেউ নেই। এবার একাকীত্বটা বড় বেশি বাজছে বোম্যানের অন্তরে।
একটু পর নিজেও নামতে শুরু করে উপরিতলের দিকে। এখনো আরেক চতুষ্কোণী খাদক হাঁ করে আছে। খালি আকাশ বন্ধ হয়ে গেল, বিশ্রাম নেয়া শুরু করল ঘড়ি, এবং আবারো পোডটা অসীম কোনো গহ্বরের সন্ধানে নেমে পড়ল চৌকোণা পথে।
কিন্তু এবার সে নিশ্চিত যে আর ফেরা হচ্ছে না সৌরজগতে। কিন্তু এখন তার বোধ স্মৃতিকাতরতার অতীতে চলে গেছে। কারণ সে এমন কিছুর খোঁজ পেয়ে গেছে যার পর আর পাওয়ার কিছু বাকী থাকে না।
হায়, মানুষ জানতে পারল না। সে মানুষকে কথাটা জানাতে পারল না।
সৃষ্টি জগতের সব সৌরজগতেই একটা করে প্রবেশদ্বার আছে। সেই সব প্রবেশদ্বার একত্র হয়েছে এমন কোথাও যেখানে সময় থমকে দিয়ে পুরো গ্যালাক্সির প্রকৃতিকে পেছনদিকে টেনে রাখা হয়েছে। জানা থাকলে সেখান থেকে ইচ্ছামতো যেখানে খুশি যাওয়া যায়। কোটি কোটি আলোকবর্ষ পথ যেতে হলে পৃথিবী থেকে জ্যাপেটাসে আসতে হবে। জ্যাপেটাস থেকে এখানে, এখান থেকে লক্ষ্য সৌর জগতের প্রবেশদ্বারে, ব্যস। এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যেতে হলে মহাশূন্য এমনকি নিজের সৌরজগৎ পেরুনোরও কোনো দরকার নেই।
এ ‘স্থান’ হল পুরো গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় স্টেশন।
অধ্যায় ৪২. অচেনী আকাশ
অনেক সামনে, পথের শেষ প্রান্ত ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে আসে। তারপর ছোট্ট স্পেসপোড তার সামনে নতুন আকাশ দেখতে পায়।
সে আবার স্বাভাবিক স্পেসে ফিরে এসেছে। কিন্তু একটু চোখ বুলিয়েই বুঝে নিতে পারে যে এটা সে আকাশ নয়। এখান থেকে পৃথিবী কত শত আলোকবর্ষ দূরে তা কেউ বলতে পারবে না। সে তারার জগৎ ভালমতো চেনে। এই নক্ষত্রগুলোর কোনোটা কোনো মানুষ খালি চোখে দেখতে পায়নি।
বেশিরভাগ তারকাই দ্যুতিময় আলোর মালায় গাঁথা। মাঝে মাঝে মহাজাগতিক ধুলো শুধু সে পথকে অদৃশ্য করে দিয়েছে। দেখতে মিল্কি ওয়ের মতোই কিন্তু অনেক অনেক উজ্জ্বল। তার মানে সে গ্যালাক্সির সেই বিজন প্রান্তর থেকে ঘন কোনো এলাকায় চলে এসেছে। সৌরজগত গ্যালাক্সির প্রান্তসীমায় অবস্থিত। এতটাই প্রান্তে যে প্রায় পুরো গ্যালাক্সিটাকেই পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেখা সম্ভব। সেখানে তারার দল আলাদা আলাদা আর অনেক দূরে দূরে বাস করে। সামনের আলোকমালাটা সম্ভবত গ্যালাক্সির কোনো বাহু।
সে আশা করে এটা মিল্কি ওয়ে। কারণ ঘর থেকে আরও দূরে চলে যেতে চায় না। একটু পরেই বুঝতে পারে ভাবনাটা শুধু বোকাটেই নয়, ছেলেমানুষী। সে এত দূরে চলে এসেছে যে এখানে এখন কোনো তারা বিস্ফোরিত হলে পৃথিবীর টেলিস্কোপে তা ধরা পড়বে কয়েক শতাব্দী পর। সহস্রাব্দও হতে পারে। এখানে থাকা আর অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে চলে যাওয়ায় কোনো তফাৎ নেই।
সে পেছনে তাকায়। কোত্থেকে উদয় হল দেখতে হবে। এবার আরো একটা হোঁচট অপেক্ষা করছিল। পেছনে কোনো স্টেশন বা জ্যাপেটাসের মতো কোনো এলাকা নেই। শুধুই কালো আকাশের গায়ে তারার মেলা। তার মানে পৃথিবী থেকে অন্য জগতে যেতে হলে জ্যাপেটাসে না গেলেও চলবে। পৃথিবীর সামনেই কোনো পথ হাজির হতে পারে, আবার যেখানে যাবার কথা সেখানকার আকাশে উগড়ে দিতে পারে।
কিন্তু নতুন করে পুরোনো ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। অচেনা আকাশে চেনা কিছুই নেই এখন। একটা নক্ষত্রদ্বার থাকলেও তাকে পরিচিত বলা যেত।
সামনে অত্যন্ত নিখুঁত একটা নক্ষত্র-গোলক। একক কোনো নক্ষত্র নয়, অসীম তারার দল। নক্ষত্রপুঞ্জ। এগিয়ে আসছে প্রতি মুহূর্তে। কেন্দ্রে আলো আর আলো, কোনো নক্ষত্রকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। বাইরের দিকটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায়নি বরং হাল্কা হয়ে মিশে গেছে কালো আকাশের সাথে। আকৃতি এত বিশাল যে হাজারটা সৌরজগৎ এর ভিতরে ছেড়ে দিলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।
বোম্যান জানে এ মহামহিম অপার্থিব এবং অকল্পনীয় বিশাল আকৃতির চেয়েও বড় এলাকাটার নাম গ্লোবুলার ক্লাস্টার। সে আবারো এমন একটা কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে যা আর কোনো মানুষের চোখ কোনোদিন দেখেনি। এমনকি সবচে শক্তিমান টেলিস্কোপেও এ দৃশ্য একেবারে অস্পষ্ট দেখা যাবে।
তার কোনো নক্ষত্রপুঞ্জের দূরত্ব মনে পড়ছে না, কিন্তু এটুকু মনে আছে যে পৃথিবীর সবচে কাছেরটাও কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।