এ উপজাতি চিরদিনই ক্ষুধার্ত ছিল, আজ তারা না খেয়ে মরতে বসেছে। সূর্যোদয়ের প্রথম ক্ষীণ আলোকমালা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে চাচ্ছে গুহার বুকে-এমন সময় চন্দ্র-দর্শী দেখে তার বাবা মরে পড়ে আছে রাতের আঁধারে। সে জানত না যে চির-বুড়োই তার বাবা। এসব সম্পর্ক তার উপলব্ধির অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। তবু সেই শুকনো শরীরটা দেখে একটু স্তব্ধ হয়ে যায়; এ অনুভূতিটা পরে নাম পাবে, কষ্ট।
দু’বাচ্চা এর মধ্যেই চেঁচাতে শুরু করেছে অন্নাভাবে। কিন্তু চন্দ্র-দর্শী মুখ ব্যাদান করে তাকাতেই তারা থেমে যায়। মায়েদের একজন দুধের বাচ্চাগুলোর পক্ষ নিল। মা বনমানুষীটা তাদের খাওয়াতেও পারেনি। কিন্তু মা-তো, তাই চন্দ্র-দর্শীর ধমকের জবাবে এক রাগ-ধরানো ভেঙচি কেটে দেয়। এই দু:সাহসের জবাব দেয়ার শক্তিও নেই পুরুষ বনমানুষ চন্দ্র-দর্শীর।
এবার যাবার মতো আলো এসেছে। গুহার ছাদ নিচু, তাই মাথা হেঁট করে চন্দ্র-দর্শী কুঁকড়ে যাওয়া লাশটা তুলে নিল। টেনে চলল নিজের পেছনে পেছনে। বাইরে বেরুতে পেরেই সে কাঁধের উপর শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দু-পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়-এ ভুবনে একমাত্র প্রাণী, যে একাজটা করতে পারে।
নিজেদের মধ্যে চন্দ্র-দর্শী ছিল এক দৈত্য। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট, অপুষ্টিতে জীর্ণ হলেও শত পাউন্ডের বেশি তার ওজন। ওর রোমশ পেশীবহুল শরীরটা মানুষ আর বানরের মাঝামাঝি। কিন্তু মাথাটা বনমানুষের চেয়ে মানবের দিকেই বেশি ঝুঁকে যায়। কপাল ততটা উঁচু নয়, অক্ষিকোটরের মধ্যে উঁচু ভাঁজ দেখা দিয়েছে; মানবতার বার্তা সে নির্ভুলভাবে বয়ে চলেছে নিজের জিনে। প্লেইস্টোসিন যুগের নির্দয় দুনিয়ার দিকে তাকাচ্ছে সে। তার অপলক দৃষ্টিতে এমন কিছু ধরা পড়ে যা আর কোনোদিন কোনো বনমানবের দৃকপাতে উঠে আসেনি। সেই কালো, গহীনে তলিয়ে যাওয়া চোখগুলোতে ভাসা-ভাসা একটু সচেতনতা খেলে যাচ্ছে-এটাই বুদ্ধিমত্তার প্রথম ঝলক যা হয়তো জন্ম-জন্মান্তরেও শিখার মতো জ্বলে উঠবে না; হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তলিয়ে যাবে বিলুপ্তির অতলে।
বিপদের কোনো চিহ্ন নেই, তাই চন্দ্র-দর্শী গুহামুখের প্রায় খাড়া ঢালটা বেয়ে হাচড়েপাঁচড়ে যেতে থাকে; বোঝাটা তেমন কোনো সমস্যা নয়। বাকীরা যেন এই সংকেতের আশায়ই বসে ছিল। সকালের জলপানের জন্য সাথে সাথে বেরিয়ে গিয়ে এগুতে থাকে সেই কাদাপানির নালাটার দিকে।
চন্দ্র-দর্শী উপত্যকার অন্যপ্রান্তে দৃষ্টি ফেলে-যদি অন্যদের দেখা যায়; কিন্তু ওদের মাথার টিকিটারও দেখা নেই। হয় এখনো নিজেদের গুহা ছাড়েনি নয়তো ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের দূরপ্রান্তগুলো। কোথাও দেখা না যাওয়ায় চন্দ্র-দর্শী ভুলে যায় তাদের কথা; একসাথে একাধিক ব্যাপারে চিন্তা করতে সে আজো শেখেনি। তার মস্তিষ্কই অন্যরকম।
প্রথমেই তাকে চির-বুড়োর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু এ সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয় এক-আধটু। এ মরসুমে অনেক মৃত্যু এসেছে, একটা তার নিজের গুহাতেই; তার মানে তাকে লাশটা সেখানেই ফেলে আসতে হবে যেখানে ফেলে এসেছে নতুন-শিশু কে আকাশের চাঁদটার শেষভাগ বাকী থাকতে। বাকী কাজ সারবে হায়েনার দল।
এক জায়গায় এসে ছোট্ট উপত্যকাটা মিশে গেছে দিগন্তবিস্তৃত চারণক্ষেত্রের সাথে। হায়েনারা এর মধ্যেই প্রতীক্ষা শুরু করে দিয়েছে সেখানে। তার আসার কথা জানতে পেরেই ওরা অপেক্ষা করছে। চন্দ্র-দর্শী একটা ছোট্ট দেখে ঝোঁপের কাছে লাশটা ফেলে রেখে তড়িঘড়ি করে ফিরে যায় গোত্রের বাকীদের সাথে যোগ দিতে। আগের সব হাড়গোড় এর মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেছে। আর কোনোদিন নিজের বাবার কথা চন্দ্র-দর্শীর মনে পড়বে না।
সে, তার দু সাথী, অন্য গুহাগুলোর বয়েসীরা আর সব নবীন মিলে খাবার খুঁজে ফিরছিল খরায় শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলোর আশপাশে। জায়গাটা উপত্যকার উপরদিকে। গুটি-গুটি ফল আর টসটসে লতাপাতা তাদের আরাধ্য। শিকড়বাকড় নাহয় হঠাৎ ভাগ্যে ঘটে যাওয়া গিরগিটি-ইঁদুর জাতীয় প্রাণীও তারা খোঁজে। একদম বাচ্চা আর অচল বুড়োদেরই শুধু গুহায় রেখে আসা হয়। যদি সারাদিনের চষে বেড়ানোর পর এক-আধটু খাবার বেঁচে যায় তো গুহায় ফেলে আসা বাকীদের খাদ্য পাবার সম্ভাবনা আছে। তা নাহলে হায়েনাদের কপালে শীঘ্রই আবারো ভালো কিছু জুটবে।
আজকের দিনটা ভালই-কিন্তু চন্দ্র-দর্শীর কোনো অতীত স্মৃতি নেই; এক সময়ের সাথে অন্যটার তুলনা সে করতে জানে না। এক মরা গাছের গোড়ায় মৌচাক পেয়ে গেল। সবচে মজার স্বাদটা নিতে পারবে ওরা এবার। ওর গোত্র এরচে সুস্বাদু কিছু চেনে না। শেষ বিকেলে দলটাকে ঘরে তাড়িয়ে নিতে নিতেও নিজের আঙ্গুলগুলো সে চেটে চলে বেখেয়ালে। অবশ্যই, বেশ ভালো পরিমাণে হুলের গুতো জুটেছে ওর কপালে; কিন্তু সেসময়ে ও এগুলোকে থোড়াই পরোয়া করত। এখন তার খিদে মোটামুটি তৃপ্তির দিকে হেলে পড়েছে, এরচে বেশি ক্ষুন্নিবৃত্তি কোনোকালে হয়নি-এখনো সে ক্ষুধার্ত হলেও আর খিদেয় কাহিল হওয়ার জো নেই। এই আধপেটা খাওয়াটাই কোনো বনমানুষের সারা জীবনে হাসিল করার মতো একমাত্র উদ্দেশ্য।
নালার কাছে যাবার সাথে সাথে তৃপ্তি উধাও হয়ে যায়। ওপাশে অন্যেরা। ওরা প্রতিদিনই সেখানে থাকে, কিন্তু বিরক্তির কিছুমাত্র কমে না কোনোদিন।