শুধু তারকাগুলো সরে যাচ্ছিল তাদের ধারক ফ্রেম থেকে। প্রথম প্রথম সে বুঝতেই পারেনি তাদের সরে যাওয়ার ব্যাপারটা। কিন্তু পরেই আসল দৃশ্য চোখে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ছে নক্ষত্রলোক, ধেয়ে আসছে তার দিকে! কেন্দ্রের দিকের তারাগুলোকে তেমন নড়তে দেখা যায় না, পরিধির দিকেরগুলো গতিবৃদ্ধি করেই চলেছে। তারপর তারা আলোর রেখার মতো বিলীন হয়ে যায়। তার মানে উঠে আসছে জগৎটা। কেমন জগৎ এটা? কেমন জগৎ!
যেন অসীম কোনো উৎসের দিকে এই যাওয়া। মাঝখানটায় যাওয়ার পালা শেষ হবে কিনা বোঝা যায় না। সে কোনো সূর্যের বুকে পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কি এই ব্যাপার হতেই থাকবে? কিন্তু তারা কেউ সামনে আসে না। সবাই একটা বিরাট দূরত্ব রেখে সরে যায় সেই অনন্ত কালো ফ্রেমের গায়ে। উঠে আসে আরো।
এখনো শেষপ্রান্ত এগিয়ে আসেনি। মনে হয় যেন দেয়ালগুলোও তার সাথে সাথে চলেছে। কিন্তু ত্বরণ অনুভব করবে না এ কেমন কথা! নাকি সে সত্যি সত্যি স্থিরই আছে, চারদিকে ছুটে চলছে মহাকালের মহাকাশ…
শুধু স্পেস নয়, এবার সে বোঝে তার সাথে কী হচ্ছে। পোডের ইট্রুমেন্ট প্যানেলের ছোট্ট ঘড়িটিও এবার পাগলামি শুরু করে দেয়।
সাধারণত সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ দেখানো সংখ্যাগুলো দেখে বোঝ যাবার আগেই হাওয়া হয়ে যায়। এখন সে ভালভাবেই সেগুলোকে পড়তে পারছে। শেষে সময় গণক থেমে গেল সেকেন্ডের দশভাগের পাঁচ আর ছয়ের মধ্যে। ক্লান্ত সময় তার অবিরাম চলা বন্ধ করে দিয়েছে!
সে দেখতে পাচ্ছে, ঠিকমতো বুঝছে সব, এখনো চারপাশে দেয়াল। সে দেয়ালের গতি শূন্যও হতে পারে, আবার আলোর চেয়ে লাখগুণ বেশিও হতে পারে। কেন যেন সে একবিন্দুও আশ্চর্য হলো না। মনে কেন যেন একটুও ভয় নেই। উল্টো অবাক করা শান্ত ভাব ঘিরে ধরেছে তাকে। একবার তাকে স্পেস মেডিকরা হ্যালুসিলেশন ড্রাগ দিয়ে পরীক্ষা করেছিল। সে হঠাৎই বুঝছে, তার চারপাশটা অবাক করা, তাতে কী-ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
একটা রহস্যের আশায় সে শত কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছে, সে রহস্য এবার হাজির হবে সামনে।
সামনের চৌকোণাটা আলোময়। উজ্জ্বল তারাগুলো একটা দুধ-সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন স্পেস পোড কোনো অদৃশ্য সূর্যের আলোয় আলোকিত কুয়াশা-মেঘের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এবার সে টানেল ছেড়ে যাবে। কিন্তু দূরপ্রান্ত এখনো এগিয়ে আসেনি। তারপর একসময় এগিয়ে আসে, ছড়িয়ে পড়ে তার সামনে।
হঠাৎ মনে হল সে উপরে উঠছে। সে কি জ্যাপেটাসের অন্য প্রান্ত ধরে উঠে আসছে? মুহূর্তেই বাতিল হয়ে যায় ধারণাটা। এর সাথে জ্যাপেটাস বা মানবীয় হিসাব নিকাশ বা সৌরজগতের কোনো সম্পর্ক নেই।
কোনো বায়ুমণ্ডল না থাকায় সে অবিশ্বাস্য নিচের দৃশ্যও দেখছে পরিষ্কার। ওটা একেবারে সমতল! সে নিশ্চয়ই এক অকল্পনীয় রকমের বড় ভুবনের উপর ভাসছে। নিচে দেখতে পেল অনেক অনেক সূক্ষ্ম দাগ, সেগুলো নিশ্চয়ই মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে আছে। যেন কোনো পাগলাটে মহাকাশের খেলুড়ে ত্রিকোণ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ এসব এঁকে খুব মজা পেয়েছে কোনোদিন। বোম্যান কয়েকটা এলাকার মাঝখানে কালো কালে কী যেন দেখতে পায়। ভালমতো খেয়াল করে সবগুলোর ভিতরেই একটা করে টি এম এ’র অস্তিত্ব দেখতে পায় সে।
উপরের আকাশ আরো অদ্ভুতুড়ে আকার নিয়েছে, নিচের অসীম সমতলের চেয়েও বিস্তৃত তর হাল। সেখানে কোনো তারা নেই, মহাকাশের চিরাচরিত অন্ধকার নেই। আছে শুধু হাল্কা দ্যুতির দুধসাদা অসীম এক আকাশ।
বোম্যান একবার অ্যান্টার্কটিকের এক বর্ণনা শুনেছিল। পিংপং বলের মতো চারদিক সাদা আর সাদা। কথাটা নিশ্চয়ই সেখানে না মানিয়ে এখানে মানিয়ে যায়। এখানকার সাদার পেছনে কোনো মহাজাগতিক বস্তুগত কারণ নেই। এ হল আসল বায়ুশূন্যতা।
এবার তার সচেতনতা অন্যদিকে চলে যায়। জায়গাটা পুরোপুরি খালি নয়! উপরে, অকল্পনীয় উপরে ছোট ছোট কালো বিন্দু চোখে পড়ে। সেগুলো কী?
বোম্যান একজন জ্যোতির্বিদ। স্থানটা চিনে নিতে তার তাই তেমন সমস্যা হয় না।
সেই কালো বিন্দুগুলোই সাদা নক্ষত্র ছিল, আর দুধসাদা স্পেস ছিল কালো। সে গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ের ছবির উল্টা দৃশ্যটা দেখছে!
খোদার দোহাই! আমি কোথায়! নিজেকে প্রশ্ন করে বোম্যান। প্রশ্ন করেই হঠাৎ সে বুঝে ফেলে আর কোনোদিন সে উত্তরটা জানতে পারবে না। দেখে মনে হচ্ছে পুরো মহাবিশ্ব…পুরো ইউনিভার্সকে উল্টে দেয়া হয়েছে, টেনে বাইরের দিককে ভিতরে আর ভিতরের দিকে বাইরে এনে ফেলা হয়েছে। এ স্থান মানুষের জন্য নয়।
ক্যাপসুলটা যথেষ্ট গরম হলেও ডেভ বোম্যান কাঁপতে শুরু করে থরথরিয়ে। বন্ধ করতে চায় নিজের চোখ, অস্বীকার করে চারপাশের অনিশ্চয়তাকে। কিন্তু কাজটা কাপুরুষতা। সে চোখ বন্ধ করবে না। সে দেখবে। শেষ পর্যন্ত দেখবে।
জগত্তা ধীরে ধীরে তার নিচে ঘুরে উঠল। কিন্তু দৃশ্যপটে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনুমানে ধরে নেয় এখন সে সারফেসের দশ মাইল উপরে আছে। হাজার চেষ্টা করেও জীবনের কোনো চিহ্ন বের করতে পারেনি। বুদ্ধিমত্তা এখানে এসেছিল। নিজের ইচ্ছামতো কাজ করিয়েছে। তারপর চলে গেছে কাজ শেষে।
হঠাই প্রায় বিশ মাইল দূরে উপরে আরেকটা জিনিস ভাসতে দেখল। তাকাতে তাকাতেই সেটা চলে গেল দূরে। সিলিন্ডারের মতো লম্বাটে জিনিসটা হাজারো ধাতব কাঠামোর একটা সমন্বয়। কোনো কমলালেবুকে ছিলে ফেললে যেমন হয় তেমন করেই এর বাইরের পুরো দেয়াল আর আবরণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কত হাজার বছর ধরে শূণ্য মহাকাশযানটা ঘুরতে ঘুরতে এ অবস্থায় পড়েছে কে জানে! আর কারা সেই প্রাণী!