সূর্য এখন আর সব নক্ষত্র থেকে একটু বেশি উজ্জ্বল, এই যা। যে কেউ এর দিকে খোলা চোখে তাকাতে পারে। বোম্যান জানালার সামনে হাত পেতে দিয়েও সূর্যের উত্তাপ পায় না।
সে এবার বেরিয়ে যাচ্ছে, হয়তো শেষবারের মতোই। তার এই ধাতব বাড়িটা নিজের কাজ করতেই থাকবে, বোম্যান ফিরে আসুক আর না আসুক।
আর সে যদি ফিরে আসে তাহলে আরো বেশ কয়েক মাস বেঁচে থাকবে সজ্ঞানে। হাইবারনেশনের দেখভালের জন্য কোনো কম্পিউটার না থাকায় তার বাঁচার আশা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ডিসকভারি টু আসবে চার পাঁচ বছর পর।
সে এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় না। সামনে শনির উজ্জ্বল সোনালী গোলার্ধ ভেসে আছে। পুরো ইতিহাসে সেই এ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য অর্জনকারী একমাত্র মানুষ।
সেই শনি রিংগুলোর প্রান্তে টাইটানকে এক উজ্জ্বল তারার মতো দেখাচ্ছে, বাকী উপগ্রহগুলো ম্লান। এই শতাব্দীর অর্ধেকটা কেটে যাবার আগেই মানুষ হয়তো এই সবগুলোতেই পা ফেলবে, কোন্ রহস্যের চাদর উঠে গেল তা জানার জন্য শুধু সে-ই বেঁচে থাকবে না।
অন্ধ সাদা চোখের তীক্ষ্ণ প্রান্ত ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তার একটাই আশা, কথাগুলো যেন সব সময় দেড় আলোকঘণ্টা দূরের পৃথিবীতে চলে যায়। একবার নিরবতায় হারিয়ে গেলে মানুষ কোনোদিনই তার পরিণতির কথা জানবে না।
বহু উপরের কালো আকাশে ডিসকভারি এখন এক তারা হয়ে জ্বলছে। ত্বরণ কমানোর জন্য পোডের ঘোঁট জেটগুলো কাজ শুরু করবে, এগিয়ে আসবে, চির রহস্যের দেশ, শুধু চোখের সামনে থেকে উবে যাবে ডিসকভারি; এতদিনের সাথীকে সে আর খালি চোখে দেখতে পাবে না।
ত্বরণ বেশি হয়ে গেলে আবার অনেক বেশি ফুয়েল খরচ হবে গতিটা কমিয়ে আনতে। কিন্তু এখানে পুরো পোডের ওজন হবে মাত্র কয়েক পাউন্ড; তাই সে সহজেই মানিয়ে নেবে। আর না হলেও কিছু যায় আসে না। এখানে, পোডের ভিতর বা উপগ্রহের উপরে দু-একমাস আগে মৃত্যুবরণ করা আর সেখানে বেশি বাঁচায় তেমন কোনো ফারাক নেই…
নিচের সাদা সমতলের উপর স্থির দাঁড়িয়ে আছে কালো স্তম্ভটা কী এক অজানা অহংকার বুকে নিয়ে। সে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে আছে এখন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে এর উচ্চতা কমবেশি দু-হাজার ফুট হবে। গায়ের অনুপাতও সেই ১:৪:৯।
‘আমি এখন মাত্র তিন মাইল দূরে। চার হাজার ফুট উপরে অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেট চেপে ধরব। এখনো বিন্দুমাত্র বৈচিত্র্য নেই। নেই কোনো সাড়া। এত বছর পর তোমরা এক-আধটু উল্কাটুল্কার ক্ষয়ক্ষতিও আশা করতে পার, তাও নেই। একেবারে মসৃণ!
‘ছাদের উপর কোনো টুকরো পড়ে নেই। কোনো খোলা-বন্ধের ব্যাপারও চোখে পড়ছে না। আশা করছি সেখানে ঢোকার কোনো…
‘এখন আমি ঠিক পাঁচশ ফুট উপরে ভাসছি। ডিসকভারি সরে যাবার আগেই আমাকে ফিরতে হবে। উপরেই ল্যান্ড করব। আশা করি সাথে সাথে আমাকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে না।
‘এক মিনিট… ব্যাপারটা বেখাপ্পা…’
আর কোনো শব্দ নেই। সে কী দেখল তার বর্ণনা দেয়ার সময়ই পায়নি। জিনিসটাকে অন্যরকম লাগছিল কিন্তু সেটা সে বুঝতেও পারেনি। চোখের ভুল হতে পারে…যেন ওটা সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। যেন ভিতরের দিকটা বাইরে আর বাইরের দিক ভিতরে চলে আসছে…কিংবা উপর থেকে চোরাবালি চলে যাচ্ছে নিচের দিকে…।
ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছিল সেখানে। এটা আরো বিশাল, স্থির কোনো স্তম্ভ নেই। অসম্ভব, অবাস্তব, অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাই চোখের সামনে ঘটে গেল। যাকে ছাদ মনে হচ্ছিল সেই চলে গেছে কোন্ অতল গর্ভে। তার শেষ নেই। যেন কোনো অন্ত বিহীন পথে প্রবেশ করছে সে…
জ্যাপেটাসের নয়ন এবার জীবন পেয়েছে, পলক ফেলেছে অনেক অনেক বছর পর।
ডেভিড বোম্যান একটা মাত্র ভাঙা বাক্য বলার সুযোগ পেল নয়শো মিলিয়ন মাইল দূরের মিশন কন্ট্রোলের মানুষদের কাছে যেটা যুগ-যুগান্ত ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে:
‘জিনিসটা ফাঁপা-এর কোনো অন্ত নেই-আর-ওহ মাই গড! এটা তারায় তারায় ভরা!…
অধ্যায় ৪০. তোমার দেখা পাব বলে …
নক্ষত্ৰদ্বার খুলে গেল।
বন্ধ হলো নক্ষত্ৰদ্বার।
এক অতি ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে আবার স্থানটা ঠিক হয়ে গেল; আগের মতো।
আরো একবার জ্যাপেটাস বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। ত্রিশ লাখ বছর পর প্রাণের ছোঁয়া পেয়ে আবার উপগ্রহটা একাকিত্বের যন্ত্রণা ভোগ করবে।
কিন্তু উপরে এক সাথী আছে তার। ডিসকভারি এখনো ঠিক পরিত্যক্ত হয়ে পড়েনি। সে তার প্রভুর খবর পৌঁছে দিচ্ছিল বিজন প্রান্তর ভেদ করে আরেক কোণে।
এ সংবাদ না করবে কেউ বিশ্বাস, না পারবে বুঝতে।
৬. নক্ষত্রের প্রবেশদ্বার
ষষ্ঠ পর্ব : নক্ষত্রের প্রবেশদ্বার
অধ্যায় ৪১. মহাকেন্দ্র
গতির কোনো অনুভূতি ছিল না কিন্তু সে সেই অসম্ভব তারার রাজ্যে পড়ে যাচ্ছিল যেগুলো উপগ্রহের কালো বুকে জ্বলছে অবিরত। না-ঠিক সেখানে ওরা ছিল না। সে বুঝতে পারে। সে হতাশভাবে ভাবে, আগেই হাইপারস্পেস আর ট্রান্সডাইমেনশনাল ডাক্ট থিওরিতে বিশ্বাস করা উচিত ছিল।
কিন্তু আর সব শতকোটি মানুষের কাছে সেটা থিওরি হলেও ডেভিড বোম্যানের কাছে নয়।
সম্ভবত ছাদটার ছাদছাদ ভাবই আসলে দৃষ্টিভ্রম, এর কোনো তল নেই। কিংবা উপরিতল আছে, সেটা মিলিয়ে গেছে তাকে ভেতরে নেয়ার জন্য। কিন্তু ঠিক কোথায় নেয়ার জন্য? এক বিরাট চৌকোণা গর্তের ভিতর সে সরাসরি পড়ছিল। গতি বাড়ছিল প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু তলাটা কখনোই এগিয়ে আসেনি।