তাদের ধৈর্য ছিল, কিন্তু তারা তখনো অমর নয়। ইউনিভার্সের দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের দশ হাজার কোটি সৌরজগতে করার মতো অনেক অনেক অনেক কাজ বাকী। অন্য দুনিয়া ডাকছে। সুতরাং আবার শূন্যতায় ভেসে পড়া তারা জানে-আর কোনোদিন পায়ের চিহ্ন এ পথে পড়বে না।
তার আর প্রয়োজন নেই। যে দাসদের ফেলে গেল তারাই বাকীটা সেরে ফেলবে।
পৃথিবীর যুগে বরফযুগ হাজারটা হিমবাহ নিয়ে এল, আবার ফিরে গেল; শুধু উপরের চাঁদে কোনো পরিবর্তন নেই। তার বুকে লুকানো আছে সবটুকু রহস্য। মেরুতে বরফ জন্মানোর চেয়েও ধীর গতিতে গ্যালাক্সি জুড়ে সভ্যতার জোয়ার উঠে এল, ভরে ভাসিয়ে দিল চারপাশ।
কত শত শত সাম্রাজ্য যে উঠে এল, কত সাম্রাজ্যের হল পতন তার ইয়ত্তা নেই। তারা শুধু বংশধরের জন্য জ্ঞানের সঞ্চয়টুকু রেখে হারিয়ে যায়। কখনোই পৃথিবীর কথা ভুলে যাওয়া হয়নি-কিন্তু তাতে কী, ফিরে আসা প্রশ্নাতীত। আরো লক্ষ লক্ষ নিরব দুনিয়ার মধ্যে এও এক। এদের মধ্যে কারো মুখে বুলি ফুটবে, কেউ কেউ স্তব্ধ থেকে যাবে চিরদিনের জন্য।
এবং এখন, আর সব নক্ষত্রলোকে বিবর্তনের এক নতুন জোয়ার শুরু হয়েছে। সেই অভিযাত্রীরা তাদের রূপ বদলে ফেলেছে মেশিনগুলো শরীরের চেয়ে বেশি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে। প্রথম প্রথম শুধু শরীর সেখানে জায়গা করে নিত, তারপর মস্তিষ্ক, তারপর শুধু চিন্তা। এবার তারা নক্ষত্রলোকে ঠিকমতো ঘুরে বেড়াতে পারল। তারা আর স্পেসশিপ বানায় না। তারা নিজেরাই স্পেসশিপ।
কিন্তু মেশিন-প্রাণীদের যুগ খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল। ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের সাথে লাখো বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা স্বয়ং স্পেসের গায়ে জ্ঞানকে বন্দী করে রাখতে শিখল। জ্ঞানকে তারা অসীম ভবিষ্যৎ পর্যন্ত আলোর জমাট ফটিকে লুকিয়ে রাখতে জানে। এবার তারা রেডিয়েশনের সৃষ্টি, অবশেষে বস্তুর নাগপাশ থেকে অনমুক্তি পাওয়া গেল।
কিন্তু রেডিয়েশন তথা তেজস্ক্রিয়তায়ও নাক সিঁটকানো থামে না। এরও একটু সীমাবদ্ধতা আছে। কণা নির্ভর ও পরীক্ষারত বস্তুর জন্য ক্ষতিকর এ পথ ছেড়ে সেই মুক্তিটাকে সত্যিকারের বাস্তবতা দেয়ার আশায় এবার তারা বিশুদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাদের ছেড়ে আসা খোলসগুলো মৃত্যুশীতলতা নিয়ে নেচে বেড়ায় হাজার হাজার বিশ্বে।
এখন তারা নিহারীকার ভাগ্যবিধাতা, সময় আর তাদের ছুঁতে পারে না। তারা এখন সব নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে চলতে জানে, মহাশূন্যের যে কোনো অতল সমুদ্রে শক্তির গাঢ় কুয়াশা হয়ে মিশে যেতে পারে।
কিন্তু আজো তারা তাদের পূর্বপুরুষদের শুরু করা পরীক্ষণের পথ ছেড়ে দেয়নি।
মহাশূন্যের চাষীরা এখনো রোপণ করা চারার পরিণতি দেখে।
অধ্যায় ৩৮. প্রহরী
‘শিপের পরিবেশ একেবারে বদলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় আমাকে একটা মাথাব্যথা নিয়ে থাকতে হয়। সব সময় অক্সিজেন পরিশোধন কাজ চললেও দৃষিতটা একেবারে সরিয়ে দেয়া যায় না। মাঝেমধ্যেই আমাকে পোড থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসতে হচ্ছে…
‘আমি কোনো সাড়াই পাচ্ছি না টি এম এ-টু থেকে। তোমরা যে নাম দিয়েছ তার মর্মও সে রাখছে না। কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র নেই।
‘ডিসকভারি ষাট মাইলের চেয়ে বেশি কাছে যায় না। আমি ত্রিশ দিনের মধ্যে অভিযান চালাতে চাচ্ছি, কিন্তু তখন জিনিসটা অন্ধকারে চলে যাবে।
‘এমনকি এ মুহূর্তেও জিনিসটা আলো আর আঁধারের মাঝখানে। খুব বিরক্তিকর এর অবস্থা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কদ্দিন এমন সাড়া ছাড়া থাকা যায়?
‘সুতরাং, আমি তোমাদের অনুমতি চাই। পোডটার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। জিনিসটাকে একেবারে কাছ থেকে দেখে আসব। দেখেশুনে ভাল মনে হলে পাশে কিংবা উপরে ল্যান্ড করতে পারি।
‘শিপ আমার উপরেই থাকবে নামার সময়, তাই নব্বই মিনিটের বেশি বাইরে থাকছি না।
‘তোমরা যাই বলনা কেন, আমি জানি এছাড়া আর কিছু করার নেই। শত কোটি মাইল এসেছি-ষাট মাইলের জন্য থেমে থাকতে পারি না।
.
সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে নক্ষত্রলোকের প্রবেশদ্বার সেই শিপটাকে দেখছে। এর স্রষ্টারা একে হাজারো কাজের জন্য বানিয়েছে-এটি সেসব কাজের মধ্যে অন্যতম। এটা বুঝতে পারে সৌর জগতের উষ্ণতা ছেড়ে এদুর আসার মানে।
এটা জীবিত হলে রোমাঞ্চ অনুভব করত। কিন্তু তার সে অনুভূতির প্রশ্নও ওঠে না। সে অপেক্ষা করছে ত্রিশ লাখ বছর ধরে, তার অপেক্ষার দৈর্ঘ্য অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত।
তাই শুধু দেখে, কোনো সাড়া দেয় না। একটু তেজস্ক্রিয়তার ছোঁয়া পেয়ে বোঝার চেষ্টা করে উৎসকে।
শিপ নিচে নেমে এসেছে। বারবার নিজের রেডিও বিস্ফোরণের সুরে কথা বলছে। এক থেকে এগারো পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যাগুলো আউড়ে যাচ্ছে ইচ্ছামতো।
এবার আরো হাজারো পথে লাখো ইশারা আসে। এক্স-রে, অতিবেগুনী রশ্মি, অবলোহিত…
নক্ষত্রদ্বার কোনো শব্দ করে না। এর বলার কিছুই নেই।
একটা বিশাল বস্তুকে নেমে পড়তে দেখে এটা সাথে সাথে সব হিসাব কষে ফেলে। লজিক ইউনিট তল্লাশী চালিয়ে জানতে পারে করণীয়। অনেক অনেক আগেই এ সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছিল।
শনির ঠাণ্ডা আলোয় তারকা জগতের প্রবেশমুখ তার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে।
ধীরে, অতি ধীরে, ত্রিশ লাখ বছর পর।
অধ্যায় ৩৯. চোখের ভেতর
ডিসকভারি শিপটাকে সে শেষবার আধ আকাশ জুড়ে থাকতে দেখল। তার চোখে সামান্য পরিবর্তন ধরা পড়ছে। মহাকাশযানটার বিভিন্ন হ্যাঁচ, সংযোগ, বিভিন্ন ধরনের প্লাগ আর যন্ত্রাংশকে সে চিনতে চেষ্টা করে। সূর্যালোকে স্নাত হয়ে এত লম্বা পথ পরিক্রমা শেষে এখানে আসায় শিপটা বোধহয় ম্লান হয়ে গেছে।