ডিসকভারির কার্গো বে’ তে স্যাটেলাইটটা নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তার দু’দিন পর ওয়েস্টারও উদ্ধার পায়। সে দুটিই ফিরে আসে পৃথিবীতে; আবার চেক করো, আবার ঠিক করো, আবার পাঠাও কালো আকাশে-এবার সফলতা; মানুষের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাস ছোট কিন্তু সাহসে ভরা দুর্দান্ত কাজ।
এখনো আমি ফুরিয়ে যাইনি। জো’র এই ঘটনার পর আমি একটা বই পাই হাতে, বইটার নাম, ‘অ্যান্টারিং স্পেস: অ্যান অ্যাস্ট্রোনট’স ওডিসি’, সেই সাথে মলাটে একটা লেখা ছিল:
প্রিয় আর্থার, আমি যখন ছোট্ট এক ছেলে, আপনি আমাকে লেখার পোকা আর স্পেসের পোকা-দুয়েই আক্রান্ত করেন। কিন্তু কেন বলেননি কাজ দুটো বাস্তবে করা কত্তো কঠিন!’
আমি আবেগে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ ধারার সংবর্ধনা আনন্দ দেয় অসীম, সেই সাথে রাইট ব্রাদার্সের মতো অনুভূতি এনে দেয়।
যে উপন্যাস আপনারা পড়তে যাচ্ছেন সেটা মাঝেমধ্যে ভালোভাবেই সমালোচিত হয়েছে। বিশেষত বিস্তর ব্যাখ্যা দেয়াটা একটু দৃষ্টিকটু ঠেকেছে সমালোচকের চোখে। সেই সাথে আরো একটা অভিযোগ, মুভির কয়েকটা রহস্যকে খোলাসা করে ফেলা হয়েছে। এমনকি রক হাডসন প্রিমিয়ারে বলেছিলেন, ‘ক্যান সামওয়ান টেল মি, হোয়াট দ্য হেল দিস ইজ অল অ্যাবাউট?
কিন্তু আমি মোটামুটি স্থির, বইতে সব সময়ই চলচ্চিত্রের চেয়ে একটু বেশি খোলাসা থাকা দরকার, এখানে শব্দ নেই, দৃশ্য নেই, তারপরও বেশি একাগ্রতা আছে। তারপরও আমি ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুললাম ২০১০ লিখে। (পরে পিটার হেইমস্ এটাকেও একটা দারুণ চলচ্চিত্রের রূপ দেন।) জটিলতা বাড়ালাম ২০৬১ লিখে, জটিলতা বাড়ালাম ৩০০১ লিখে।
কোনো ট্রিলজি’রই আসলে চারটার বেশি খণ্ড থাকা মানায় না। তাই প্রমিজ করতে পারি, ৩০০১ ই ফাইনাল ওডিসি।*
[* লেখক বেশিদিন প্রমিজ ধরে রাখতে পারেননি, সর্বজয়া মহাকাব্য এগিয়ে গেছে, অশীতিপর সর্বশ্রদ্ধেয় লেখক, স্পেস সায়েন্স ফিকশনের জনক আর্থার সি ক্লার্ক এই এখনো লিখছেন ওডিসি’র পঞ্চম পর্ব।]
প্রারম্ভ কথন
প্রতিটি জীবিত মানুষের সামনে এখন ত্রিশটা ভূত নেচে বেড়ায়। কারণ এখন জীবিত মানুষের সাথে মৃতদের অনুপাতটা এমনি। সময়ের জন্মের পর মোটা দাগে দশ হাজার কোটি মানুষ হেঁটে গেছে ধরিত্রীর এই পথ ধরে।
এখন, সংখ্যাটা আগ্রহ জাগায়। কারণ, আমাদের স্থানীয় সৃষ্টি জগৎ, স্থানীয় গ্যালাক্সি দুধসায়রে বা মিল্কি ওয়েতে কমবেশি এই সংখ্যক তারকাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তো, এই পথে চলে যাওয়া প্রতি মানবের জন্য একটা করে নক্ষত্র আলোকদায়িনীর রূপ নিল।
কিন্তু তাদের প্রত্যেকেইতো আরাধ্য সূর্যদেব। বেশিরভাগই আমাদের কাছের নক্ষত্র, যাকে আমরা সূর্য বলে জানি তারচে অনেক অনেক বড়। এবং তাদের অনেকেরই, সম্ভবত বেশিরভাগেরই নিজস্ব আরাধনারত গ্ৰহজগৎ থাকার কথা। তাই, মানবজাতির প্রত্যেক সদস্যকে অসীম জায়গা দেয়ার মতো যথেষ্ট স্থান এই এক জগতে আছে। সেই প্রথম বন-মানবের মতো একটা করে নিজস্ব, একেবারে একার ভূমি দিয়ে নিজের মতো বেহেস্ত বা দোজখ সাজিয়ে দেয়া কোনো কঠিন কাজ নয়।
সেই দূর, তারার দেশের সম্ভাব্য স্বর্গ বা নরকের মধ্যে ক’টায় এখন বসতি আছে? সৃষ্টির কোন্ কোন্ সিঁড়ি বেয়ে?
অনুমানের কোনো উপায় নেই। আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে স্বপ্ন হয়ে থাকবে যে মঙ্গল বা শুক্র তাদের চেয়েও লক্ষ লক্ষ গুণ দূরে অবস্থিত সবচে কাছের তারকা-ভুবনটা।
কিন্তু দূরত্ব বিনাশী নয়, দূরত্ব নশ্বর। আমরা, মানবজাতি, একদিন মিলিত হব আমাদের সমকক্ষদের সাথে কিম্বা আমাদের স্বত্বাধিকারীর সাথে; তারার দেশ পেরিয়ে গিয়ে।
মানুষ নিজের অগ্রগতিকে মেনে নিতে বেশ অস্বস্তিতে ভোগে। কেউ এখনো আশা করে যে তারার দেশ ডিঙানো যাবে না। এমন ডিঙি আসবে না কখনো। কিন্তু দলে ভারি হতে থাকারা আজ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়, এমন মিলন কেন হল না আজো, এখনো, যেখানে আমরা বেরিয়ে পড়তে শিখেছি স্পেসে?’
কেন নয়, অবশ্যই। সেই অতি বাস্তব প্রশ্নের একটা মোটামুটি সন্তোষজনক জবাব দেয়া যায়। কিন্তু মনে রাখবেন, এটা শুধুই এক কল্পনার জাতক।
বাস্তব, আর সব সময়ের মতোই, হবে আরো আরো অনেক অনেক অবিশ্বাস্য।
১. প্রচীন রাত্রি
প্রথম পর্ব – প্রচীন রাত্রি
অধ্যায় ১. ধ্বংসের পথ
এবারের অনাবৃষ্টি চলল কোটি বছর ধরে; এরও অনেক আগেই চারপেয়ে সরীসৃপ[১] সাম্রাজ্যের হয়েছে পতন। এই নিরক্ষীয় অঞ্চলটা অনেক অনেক পরে নাম পাবে আফ্রিকা। এই এখানে, অস্তিত্বের লড়াই পেয়েছে নিষ্ঠুরতার এক নতুন মাত্রা; কিন্তু আজো অস্তিত্ব-বিজয়ীর দেখা নেই। শূন্য, খটখটে মাটিতে একদম ছোট নয়তো একেবারে গতিময় নাহয় পুরোপুরি নির্দয়েরাই পারত বিবর্তনের ফুল ফোঁটাতে। বড়জোর দেখতে পেত বাঁচার ক্ষীণ আশা।
দিগন্তজোড়া তৃণভূমির বনমানুষেরা এসব বৈশিষ্ট্যের কোনোটা নিয়েই জন্মায়নি। তাই পারেনি বসুধাকে পুস্পিত করে তুলতে। এরই মধ্যে প্রজাতিগত অস্তিত্বের দৌড়ে পড়ে গেছে অনেক অনেক পেছনে। তাদের জনাপঞ্চাশেকের একটা দল একসারি গুহা দখল করে বসেছিল। গুহাটার পাশে জ্বলে পুড়ে খাক হওয়া এক উপত্যকা। ভ্যালিটাকে দুভাগ করেছে শামুক-গতির এক ছোট্ট উষ্ণ প্রসবণ। উত্তরে পাহাড়ের তুষার গলে যায়; দু’শ কিলোমিটার সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে নালাটা আসে এখানে। দুঃসময়ে প্রসবণটা উবে যেত একদম, গোটা জীবন টেনে চলত তৃষ্ণার ছায়ায় পিছলে গিয়ে।