উনিশশো পঁয়ষট্টির হিসাবে স্ট্যানলি ভবিষ্যৎ কল্পনায় অসম্ভব জটিলতা আনছিলেন। ব্যাপারটা আরো গুবলেট হয়ে যায় যখন সিদ্ধান্ত হল যে শু্যটিং হবে ইংল্যান্ডে যেখানে তিনি এখনো নিউইয়র্ক থেকে পাততাড়ি গোটাননি। গোদের উপর বিষফোঁড়া, কোনোমতেই তার আকাশ ভ্রমণ চলবে না।
সমালোচনা করছি না কিন্তু, পাইলটের লাইসেন্স নেয়ার সময়ও স্ট্যানলির অবস্থা বেশি সুবিধাজনক ছিল বলে মনে হয় না। ঠিক যে কারণে ১৯৫৬ সালে আমি সিডনিতে ড্রাইভিং টেস্টে পাশ করার পর আজো হুইল হাতে নিইনি। আমিও জীবনকে বড্ড ভালোবাসি।
স্ট্যানলি ছায়াছবিটা শেষ করছেন, আমি টানাটানি করছি উপন্যাস ভার্সনটা নিয়ে, শেষভাগ নিয়ে যুদ্ধ করছি। কিন্তু ছাপার বেলায় তার সাথে কথা বলে নেয়ার সময় নেই। তিনি কাজে নাক পর্যন্ত ডুবে আছেন দিনরাত। কসম কেটেছিলেন, বই প্রকাশের আগে মুভিটা মুক্তি দেয়ার জন্য হন্যে হয়ে যাননি। কিন্তু আমি হন্যে হয়ে গিয়েছিলাম আটষট্টিতে।
এর জটিল গোলকধাঁধা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই, মুভি থেকে বই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন হবেই। স্ট্যানলি সিদ্ধান্ত নিলেন, ডিসকভারি শিপটা বৃহস্পতিতে নামবে, যেখানে মূল উপন্যাসে সেটা শনির অতিথি, বৃহস্পতির গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্সকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যায়।
গতিবৃদ্ধির এই পথ ব্যবহার করেছিল ভয়েজার স্পেসক্রাফট; এগার বছর পর।
শনির বদলে কেন বৃহস্পতি? অন্তত তাতে করে কাহিনীর ধারা আরেকটু সহজ হয়, ব্যস। কিন্তু তারচে বড় কারণ হল, স্পেশাল ইফেক্ট ডিপার্টমেন্ট এমন শনি তৈরি করতে পারেনি যেটা স্ট্যানলিকে খুশি করতে পারবে। তাতে ভালই হল, কারণ ভয়েজার মিশনে শনির বলয়কে কল্পনার চেয়েও জটিল হিসেবে উপস্থাপিত করেছিল পরে; ফলে সেই শনি উপস্থাপিত হলে এতদিনে ছবিটা রদ্দি হয়ে যেত।
জুলাই আটষট্টিতে উপন্যাসটা মুক্তি পাবার এক যুগেরও পরে আমার সেই ওডিসি নিয়ে দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। সব তো আর আমাদের ইচ্ছানুযায়ী চলে না, ভয়েজারের সেই দারুণ অভিযান আমাকে আরো খুশি করল। আমি আর স্ট্যানলি যে জায়গা নিয়ে স্বপ্নের বেসাতি করেছিলাম সাঁৎ করে সেটাই বাস্তবের দোরগোড়ায় কড়া নাড়তে শুরু করল। বদলে গেল আমার মন-মগজ। কে জমাট পানিতে মোড়া উপগ্রহ আশা করেছিল, কে ভেবেছিল সালফারের অগ্নিগিরির শত কিলোমিটার উঁচু আগুন-বর্ষণ রূপে দোজখ লুকিয়ে আছে বৃহস্পতির আরেক উপগ্রহে।
আজ, সায়েন্স ফিকশন আরো বিশ্বাস্য হতে পারে সত্যিকার সায়েন্সের নির্যাসে সিক্ত হয়ে। তাই, ২০১০: ওডিসি টু এল, সত্যিকার বৃহস্পতির প্রকৃতিকে তুলে ধরে।
এই দু উপন্যাসে আরো একটা বড় পার্থক্য আছে।
প্রথম উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র প্রকাশিত হয় মানুষের ইতিহাস দ্বিখণ্ডিত হবার আগের ভাগে, চাঁদে পা রাখার আগেই। নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন নিরব সাগরে পা রাখলেন, ফিকশনের নতুন ধারার আবশ্যকতা বেরিয়ে এল। অ্যাপোলো এইটের চন্দ্রজয়ীরা আগেই চলচ্চিত্রটা দেখেছিলেন। চন্দ্রদেবের দূরপ্রান্তে মুগ্ধতার দৃষ্টি দেয়া প্রথম মানব চোখগুলো নাকি কী একটা খুঁজে বেড়িয়েছিল। তারা পরে আমাকে বলেছিলেন, তাদের চোখ চাঁদের বুকে কালো একটা প্রস্তর খুঁজেছিল এবং তারা সেটা আবিষ্কারের কথা প্রচারের জন্য মুখিয়ে ছিলেন।
হায়, এমন কোনোকিছুতো ছিল না সেখানে!
অ্যাপোলো তের মিশন আসলে ২০০১ এর সাথে কিছুটা যুক্ত ছিল বলা চলে। হাল কম্পিউটার যখন এই থার্টি ফাইভের ব্যর্থতার কথা ঘোষণা করে তখন সে যে কথাটা ব্যবহার করেছিল তা হল, ‘আনন্দে বাধা দেয়ায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত; কিন্তু আমাদের একটা সমস্যায় পড়তে হল…’
যাক, অ্যাপোলো তেরোর কমান্ড মডিউলের নাম ছিল ওডিসি। মুভির বিখ্যাত জরথুস্ত্র থিমের মতো করে একটা টিভি সম্প্রচার এসেছিল অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের পর। তারা পৃথিবীতে যে কথাটা পাঠিয়েছিল, তা হল, ‘হিউস্টন, আমাদের একটা সমস্যায় পড়তে হল…’
লুনার মডিউলটাকে লাইফবোটে পরিণত করে মেধাবী পরিচালনার মাধ্যমে ওডিসিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। নাসা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর টম পেইন আমার কাছে রিপোর্টটা পাঠানোর সময় কভারে লিখেছিলেন, ঠিক যেমনটা সব সময় আপনি বলে এসেছেন, আর্থার।
এমন আরো অনেক ঘটনা। মহাকাব্যিক যোগাযোগ কৃত্রিম উপগ্রহ ওয়েস্টার-ছয় বা পালাপা বি-দুই এর ঘটনাও মিলে যায়। এগুলো মিসফায়ারিংয়ের কারণে ভুল কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল চুরাশি সালে।
কাহিনীর এক পর্যায়ে ডেভিড বোম্যানের ই ভি এ’র বাড়তি অংশ নিয়ে স্পেসশিপ ডিসকভারি থেকে বেরিয়ে গিয়ে হারানো পৃথিবীকে মূল ডিশ দিয়ে বিদ্ধ করতে হয়। (দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ডস অব ২০০১ এর ছাব্বিশতম অধ্যায়ে ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তর লেখাজোকা ছিল।) তারপর সে সেটা ধরতে পেরেও আসল কাজে ব্যর্থ হয়, এলোমেলো ঘোরা বন্ধ করতে পারে না।
চুরাশির নভেম্বরে নভশ্চর জো অ্যালেন স্পেস শাটল ডিসকভারি ছেড়ে বেরোন (না, কথাটা বানিয়ে বলছি না!) তারপর পালাপার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। বোম্যানের সাথে তার একটাই পার্থক্য, ব্যাকপ্যাকের নাইট্রোজেন জেটের বা দিয়ে তিনি কাজটা করতে সফল হন।