এখন, মুভি গড়ার আগে স্ক্রিপ্ট চাই, স্ক্রিপ্ট পাবার আগে চাই একটা গল্প। যদিও কালস্রষ্টা কিছু পরিচালক শেষের দু বিষয়কে পুরো উড়িয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন, তবু তাদের ছায়াছবি খুঁজে পেতে হলে আপনাকে আর্ট থিয়েটার চষে বেড়াতে হবে। হাতে সময় নেই। আমি স্ট্যানলির হাতে আমার ছোট লেখাগুলোর একটা ফর্দ ধরিয়ে দিলাম, তার মধ্যে ‘দ্য সেন্টিনেল’কে আমাদের দুজনেরই বেশ মনে ধরল; এর উপর একটা ভিত্তি দাঁড় করানো যায়।
উনিশশো আটচল্লিশের ক্রিসমাসে শক্তি বিস্ফোরণের মতো গল্পটা লেখা হয়, বিবিসি ছোটগল্প প্রতিযোগিতার জন্য। গল্পটা মেধা তালিকায় উঠে আসেনি। আমার সারাক্ষণ ভাবনা ছিল, কোনো গল্প উঠল! যাই হোক, আমার গল্পটা পরে অ্যাক্সপেডিশন টু আর্থ-এ জায়গা পায়। আমার ভাবনা ছিল, চাঁদে একটা ট্রিগার পুঁতে রাখা হবে মানব জাতির উত্থানের সংকেত পাঠানোর জন্য।
অনেকে বলে বেড়ায় ২০০১ আসলে দ্য সেন্টিনেলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এ দুয়ের মিল ততটুকুই যতটুকু মিল আছে ওক গাছের কাণ্ড আর ফলের মধ্যে। মুভিটা বানাতে আরো হাজারটা কাঁচামাল প্রয়োজন, দরকার সেগুলোর প্রক্রিয়াকরণ। ‘ভোরের প্রথম মোকাবিলা’ থেকেও আরো কিছু তথ্য এল। এটাও পরে অ্যাক্সপেডিশন টু আর্থ-এ যুক্ত হয়। সময় কম। সব চেঁছে ফেলে নতুন করে লেখার মতো পরিস্থিতি হাতে নেই। লেখাটা একটা মাত্র পর্যায়, তারপর আরো এমন ডজনখানেক পর্যায় পেরিয়ে মুভির কারবার শেষ করতে হবে। তাই আরো অন্য চারটা ছোটগল্প থেকে কিছু কিছু অংশ নিতে হয় আমাদের। কিন্তু চলচ্চিত্রটার এই ছ’ অংশ ছাড়া বাকী সব এক্কেবারে নতুন। আমি, স্ট্যানলির সাথে মাথা ঘামাঘামি করে নির্ভেজাল লোনলি সময় কাটিয়েছি মাসের পর মাস, পশ্চিম ২৩ তম স্ট্রিটের ২২২ নম্বরের বিখ্যাত হোটেল চেলসিয়াতে, রুম নাম্বার ১০০৮-এ।
বেশিরভাগ উপন্যাস লিখেছিলাম এখানে। এখানেই ব্যথাভরা ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ডস অব ২০০১’ লিখতে হয়। কেন উপন্যাস লেখা, যেখানে তৈরি করতে চাচ্ছি একটা চলচ্চিত্র! প্রশ্ন করতে পারেন আপনারা। কথাটা সত্যি, নভেলাইজেশন (আহা!) পরে হওয়ার একটা রীতি চালু আছে বেশ জোরদার পন্থায়। স্ট্যানলি ঘড়ির কাঁটা উল্টে দিতে চাইলেন, ব্যস।
কারণ, স্ক্রিনপ্লে’র ঝক্কি জগদ্বিখ্যাত। এত বেশি ডিটেইল হতে হয় যে এটা পড়তে ততটাই খাটনি যতটা হয় লিখতে। জন ফাউলস কথাটা বেশ সুন্দর বলেছিলেন, ‘উপন্যাস লেখা হল অকূল পাথারে সাঁতার দেয়া। আর স্ক্রিনপ্লে? চিত্রনাট্য লিখতে যাওয়া সুগার রিফাইনারির তরল চিনিতে দ্রুত এগুতে চাওয়ার নামান্তর।’
একঘেঁয়েমিতে আমার এলার্জির ব্যাপারটা ধরতে পেরে স্ট্যানলি তাই হয়তো প্রথমে একটা উপন্যাস গড়তে চাইলেন। এর উপর ভিত্তি করেই সাথে সাথে একটা সুন্দর পাণ্ডুলিপি তুলে আনা যাবে। সেই সাথে কিছু পয়সা।)
এবং শেষকালে স্ক্রিনপ্লে আর নভেল একই সাথে সমাপ্তির পথে এগোয়, একই সাথে দ্বিমুখী চাপে পড়ে। তারপর আমি ছবিটা দেখলাম, যেটা খুব কম লেখকই উপভোগ করেছে। (আমার মনে হয় এনজয়’ কথাটা বলা ঠিক হল না।) আর শেষে বদলে দিলাম কয়েকটা চ্যাপ্টার।
সকালে তাড়াহুড়ো করে যে কটা ঘটনার নাম লিখেছি তা থেকে আমাদের নাকে-মুখে খাওয়ার একটু নমুনা পাওয়া যেতে পারে।
.
মে আটাশ, উনিশশো চৌষট্টি, আমি স্ট্যানলিকে বললাম, ‘তারা মেশিন হলেই ভালো, যারা জীবদেহের গঠন নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করবে আমাদের মুভিটাতে। স্ট্যানলি গররাজি, নিমরাজি, পুরো রাজি….
জুন, দুই, গড়ে দৈনিক এক বা দু-হাজার শব্দ লিখছি। স্ট্যানলি বলছেন, আমরা এখানে একটা বেস্ট সেলার পেতে যাচ্ছি অচিরেই।
জুলাই, এগারো, প্লট নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে সারাক্ষণ ‘ক্যান্টর’স ট্রান্সফিনিট গ্রুপ নিয়ে বিতণ্ডায় মেতে থাকতে হল। আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে সে একজন গণিত-জিনিয়াস।
জুলাই, বারো। সব আছে, শুধু প্লটটা নেই।
জুলাই, ছাব্বিশ। স্ট্যানলির ছত্রিশতম জন্মদিন। তারপর গ্রামে গিয়ে একটা কার্ড পেলাম, লেখা, তুমি কী করে একটা জন্মদিন পালন কর যেখানে যে কোনো মুহূর্তে দুনিয়াটা ফেটে যেতে পারে!’ ( ১৯৯৯ এর আপডেট: আশা করি সেসব কার্ড আরো পাব, প্রচুর পরিমাণে।)
সেপ্টেম্বর, আটাশ। স্বপ্ন দেখলাম, আমি যেন এক রোবট। বারবার বানানো হচ্ছে আমাকে। স্ট্যানলির কাছে আরো দু-অধ্যায় নিয়ে গেলাম, সাথে লেখা, ‘জো লেভিন এ কাজ তার লেখকদের জন্য করে না।’
অক্টোবর, সতের। স্ট্যানলি এমন একটা উপায় পেলেন যাতে এমন একটা রোবট বানানো সম্ভব হবে যেটা আমাদের হিরোদের ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যের মতো মহানায়কে পরিণত হবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
নভেম্বর আটাশ, আইজাক আসিমভকে ফোন করলাম। নিরামিষাশীর আমিষভোজীতে পরিণত হতে কী বায়োকেমিস্ট্রি দরকার তা জানতে।
ডিসেম্বর, দশ। স্ট্যানলি এইচ জি ওয়েলসের থিস টু কাম দেখে আমাকে বললেন যে তিনি জীবনে আর যাই করেন না কেন, আমার উপদেশানুযায়ী কোনো চলচ্চিত্র বানাবেন না।
ডিসেম্বর, চব্বিশ। ধীরলয়ে পাতা উল্টে যাচ্ছি, যাতে স্ট্যানলিকে একটা ক্রিসমাস উপহার হিসেবে দেয়া যায়।
.
এটুকু দেখে মনে হতে পারে আমাদের কাজের সমুদ্র শেষ হয়েছে। কিন্তু না। বিধি বাম। আসলে বইটার দু’তৃতীয়াংশ গেল মাত্র। কারণ, আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এরপর কী হতে যাচ্ছে। কিন্তু এম জি এম আর সিনেরোমা’র সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে এটুকুই যথেষ্ট। তো, বেঁধে ফেললেন স্ট্যানলি। প্রাথমিক নামটা ছিল, জার্নি বিয়োন্ড দ্য স্টার্স’। (অন্য দিকে, কীভাবে সৌরজগৎ বিজিত হয়েছিল তা মোটেও বেখাপ্পা নয়, বরং পরিপূরক। কিন্তু আপনি আমাকে ডাকবেন না, তাহলে আমিও আপনাকে বিরক্ত করব না।)