হাল নিয়ে মূল চিন্তা অন্যখানে, উনিশশো চল্লিশের দশকে ভুবনখ্যাত ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অ্যালান তুরিং যা বলেছিলেন তা কি তার বেলায় প্রযোজ্য? তুরিং একটা মজার কথা বলেছিলেন। যদি একটা মেশিনের সাথে দীর্ঘসময় কথা বলা যায় হোক কীবোর্ড দিয়ে, হোক মাইক্রোফোনে-যদি মেশিনটা সেই সময় ধরে একজন বুদ্ধিমান মানুষের মতো কথা বলে যায় তবে সে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তবে তার সাথে বলা কথা আর প্রশ্ন তাকে শিখানো কথা আর প্রশ্ন থেকে কিছুটা হলেও আলাদা হতে হবে।
হাল এক তুড়িতে তুরিং টেস্ট পাশ করেছিল।
এমন সময়ও আসতে পারে যখন হাল নিজেই শিপের কমান্ড তুলে নিবে। যদি তার সিগন্যালের জবাব কেউ না দেয় জরুরী সময়ে, সাথে সাথে সে ঘুমিয়ে থাকা ক্রুদেরকে জাগানোর চেষ্টা করবে, তাতেও কাজ না হলে যোগাযোগ করবে পৃথিবীর সাথে, তার দাবী হবে পরের আদেশগুলো।
আর তাতেও কাজ না হলে নিজের হাতেই কমান্ড তুলে নিতে হবে, বাঁচাতে হবে শিপকে, চালাতে হবে মিশন। সেই মিশন-যার আসল উদ্দেশ্য কেবল সে জানে,
জানে না তার কোনো মানব কু।
বোম্যান আর পোল মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করে নিজেদেরকে এই শিপের সামান্য চাকরবাকর আর দারোয়ান বলে অভিহিত করে। তারা কল্পনাও করেনি তাদেরই রসিকতা কতটা নিষ্ঠুর সত্যি হয়ে দেখা দিতে পারে।
অধ্যায় ১৭. মহাকাশ বিহার
শিপের প্রতিদিনকার চলাচল খুব সতর্কতার সাথে বেছে নেয়া হয়েছে। আর তাত্ত্বিকভাবে বোম্যান ও পোল জানে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিটি সেকেন্ড
তাদের কী কী করে কাটাতে হবে। তাদের কাজ বারো ঘণ্টা করে ভাগ করা। বারো ঘণ্টা একজনের ডিউটি চলবে, অন্যজনের বন্ধ। কখনোই দুজনে একসাথে ঘুমায় না। অফিসার অন ডিউটি থাকবে কন্ট্রোল ডেস্কে। অন্যজন টুকটাক কাজ করবে, দেখভাল করবে আশপাশটা, নয়তো বিশ্রাম করবে নিজের কিউবিকলে।
বোম্যান এ শিপের ক্যাপ্টেন হলেও বাইরে থেকে দেখে কেউ ব্যাপারটা ধরতে পারবে না। তারা এ সময়টায় সব কাজ ভাগ করে নেয়, নিজের পদমর্যাদাও বাদ পড়ে না।
বোম্যান দিন শুরু করে 0600 ঘণ্টায় সময়ের হিসাবটা অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল। মহাকাশবিদরা এক স্থির সময় নিয়ে নিয়েছে সারা সৃষ্টি জগতের জন্য-যাতে সময় নিয়ে ঘাপলা না বাঁধে। ক্যাপ্টেন দেরি করলেও সব সামলে নেয় হাল। জাগিয়েও দেয় তাকে। কিন্তু মিশনে নামার পর আর এর প্রয়োজন পড়েনি, একদিন পোল পরীক্ষা করে দেখার জন্য অ্যালার্মটা বন্ধ রেখেছিল, একচুল নড়চড় হয়নি বোম্যানের জেগে ওঠার সময়ে।
প্রথম কাজ হল হাইবারনেশন টাইমারটাকে আরো বারো ঘন্টার জন্য এগিয়ে রাখা। ঘুমন্ত ক্রুদের শীতনিদ্রা আরো বারো ঘণ্টার জন্য বেড়ে যায়। দুজনেই ভুলে বসলে হাল ধরে নেবে কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না, সে জরুরী পদক্ষেপ নেবে সাথে সাথে। এর কারণ অন্য কোথাও লুকিয়ে। হালকে দিয়েই এ কাজ করানো যেত। কিন্তু মিশনের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতারা চান সদা জাগ্রত কু দেখতে।
বোম্যান টয়লেট থেকে এসে চিরাচরিত ব্যায়াম সেরে নেয়। তারপর সকালের নাস্তা সারতে সারতে চোখ বুলায় ওয়ার্ল্ড টাইমসের সর্বশেষ রেডিও-ফ্যাক্সে। পৃথিবীতে থাকতে কস্মিনকালেও এত আগ্রহভরে সে সংবাদপত্র পড়েনি। এখন একেবারে সাধারণ সামাজিক গালগল্প আর রাজনৈতিক কচকচানিও তার চোখদুটোকে তন্দ্রাহত করে রাখে।
0700 বাজার সাথে সাথে সে আনুষ্ঠানিকভাবে পোলকে মুক্তি দেয়। সাথে দেয় একটা স্কুইজ কফি টিউব। সাধারণত রিপোর্ট করার মতো কোনো কিছু থাকে না। থাকলে সেটা সেরে নেয়। এরপর মনোযোগ দিতে হয় সব যন্ত্রাংশের পাঠে। ইন্সট্রুমেন্ট রিডিং শেষে কিছু টেস্ট সারার কাজ, এর ফলে অগ্রিম জানা যায় যন্ত্রপাতির হাল-হাকিকত। 1000টায় কাজ ফুরিয়ে যাবার কথা। তারপরই পড়ালেখার সময়।
সে জীবনের অর্ধেকটা পার করে দিয়েছে পড়তে পড়তে। অবসর পর্যন্ত তাই করতে হবে। বিংশ শতাব্দীর ট্রেনিং আর লার্নিং সিস্টেমকে অনেক ধন্যবাদ দেয়ার ইচ্ছা জাগে তার মনে। সে এরই মধ্যে দু-তিনটা কলেজের সমস্ত শিক্ষার সমান জ্ঞান অর্জন করেছে, আর মজার ব্যাপার হল, নব্বইভাগই তার মনে আছে।
অর্ধ শতাব্দী আগে হলে সে একই সাথে ফলিত মহাকাশবিজ্ঞান, সাইবারনেটিক্স আর মহাকাশ গতিবিদ্যার একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মান পেত। আর আজ নিজেকে যে কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দাবী করার ভাবনাটাকেও সলজ্জভাবে নাকচ করে দেয়। সে কোনোদিন একটা স্থির বিষয়ে মনোনিবেশের চেষ্টা করেনি। তাই নিজের শিক্ষকদের একদম হতাশ করে দিয়ে মাস্টার্সের বিষয় হিসেবে বেছে নেয় সাধারণ মহাকাশবিজ্ঞানের মতো একটা বিশাল, গাধা সাবজেক্টকে। এ বিষয়ের ছাত্ররা আই কিউর হিসাবে একশো ত্রিশের উপরে না যেতে পারলেও চলে, তারা সাধারণত কোনোদিন নিজের পেশার শীর্ষে যেতে পারে না।
অবশেষে তার পছন্দই ঠিক বলে বিবেচিত হয়েছে। কোনো এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হওয়ার কারণেই এখানে আসা সম্ভব হল। অন্যদিকে পোল নিজেকে ‘মহাকাশ জীববিদ্যার জেনারেল প্র্যাকটিশনার’ দাবি করে। এই দুজনের সাথে হালের অসীম স্মৃতি যুক্ত হয়ে মিশন পরিচালনাকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য।
1000 থেকে 1200 পর্যন্ত বোম্যান এক ইলেক্ট্রিক টিউটরের কাছে নিজের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা দেয়, অভিযানের জন্য প্রয়োজন এমন সব কথা জেনে নেয়। সে পুরো শিপের প্ল্যান, সার্কিট ডায়াগ্রাম, অভিযান প্রোফাইল আর বৃহস্পতি-শনির পুরো উপগ্রহ জগতের ব্যাপারে নিজের জানাশোনা নিয়ে দাপড়ে বেড়াতে পারে সহজেই।