পৃথিবীর দিকে তাক করানো একটা টেলিস্কোপতো ছিলই। শিপের দৈত্যাকার লং রেঞ্জ অ্যান্টেনার প্রান্তে বসানো টেলিস্কোপটা যেন কোনো বন্দুকের দূরবীন। একটা ব্যাপার আগে থেকেই ঠিক করা, এই দানো-অ্যান্টেনা সব সময় তার দূরবর্তী সুনির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে ফেরানো থাকবে। এর ক্রসওয়্যারগুলোর কেন্দ্র একেবারে পৃথিবীর দিকে। যোগাযোগটা সজীব, সার্বক্ষণিক। যোগাযোগের অদৃশ্য সুতোর দৈর্ঘ্য বিশ লাখ মাইল; তার সাথে প্রতি মুহূর্তের দূরত্বও যুক্ত হয়।
প্রতি ওয়াচ পিরিয়ডে অন্তত একবার বোম্যান টেলিস্কোপটা দিয়ে আকাশ খুঁড়ে পৃথিবী বের করার চেষ্টা করে। এখন পৃথিবীটা সূর্যের অনেক কাছাকাছি চলে গেছে, তাই বসুন্ধরার কালো দিকটা সারাক্ষণ মুখ ব্যাদান করে থাকে ডিসকভারির দিকে। টেলিস্কোপের চোখে এখন গ্ৰহটার চন্দ্রকলার মতো গড়ন ধরা পড়ে, দেখায় আরেক শুক্রের মতো।
আস্তে আস্তে আলোর উৎস দূরে সরে যাচ্ছে, তারই সাথে সরে যাচ্ছে অন্ধকার গ্রহ, সেটাকে তুলে আনতে হয় টেলিস্কোপে। এ এক মহা ঝামেলা। কিন্তু টেলিস্কোপের দৌড়ও কম না, সে এই আঁধার পৃথিবীকেই যত্ন করে দেখিয়ে দেয়, রাতের আলোকোজ্জ্বল শহরগুলো কখনো দেখা যায় স্পষ্ট, কখনো বা আবহাওয়ার ধোঁয়াশায় আবছা হয়ে পড়ে।
এর মধ্যে আবার পিরিয়ডিক ব্যাপারও থাকে। চাঁদ একবার ভেসে চলে যায় পেছনে, একবার সামনে, তখন পৃথিবীর অনেক অংশই অদৃশ্য হয়ে পড়ে। তবে পূর্ণ চন্দ্র পৃথিবীর মহাসাগর আর মহাদেশগুলোকে আলোয় ভাসিয়ে তুলতেও দ্বিধা করে না।
এমন সব রাতে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউগুলোও ধরা দেয় স্পষ্ট, দেখা যায় পরিচিত সব নৌবন্দর। চিরচেনা লেগুনের পাশে যে পাম গাছ তাকে ছায়া দিত সেগুলোর কথা মনে পড়ে খুব বেশি।
এখনো এ হারানো সৌন্দর্যের জন্য তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে এই সৌন্দর্যের সবটুকুই চুটিয়ে উপভোগ করেছে পৃথিবীতে থাকার সময়। বোম্যান জানে, জীবনে পঁয়ত্রিশ বছরের দেখাই সব নয়; সে চায় ধনী হতে, চায় বিখ্যাত হতে, তারপর নতুন চোখ নিয়ে দেখতে চায় সেসব স্বর্গীয় সৌকর্য। স্বভাবতই দূরত্ব সেসবকে আরো আরো মূল্যবান করে তুলছে এখন।
তাদের ষষ্ঠ সদস্য এসবের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। কারণ সে মানুষ নয়। সে হল অত্যাধুনিক এইচ এ এল নাইন থাউজ্যান্ড কম্পিউটার। হাল ন’হাজার হলো এই শিপের মস্তিষ্ক, ডিসকভারির স্নায়ুতন্ত্র।
হাল মানে হিউস্টিরিক্যালি প্রোগ্রামড অ্যালগরিদমিক কম্পিউটার। এ হল কম্পিউটার প্রজন্মের শেষ বিস্ময়, তৃতীয় প্রজন্ম[৩০]। এ প্রজন্মগুলোর কাল অতিবাহিত হয়েছে বিশ বছর পর পর।
প্রথম সাফল্য আসে উনিশশো চল্লিশ সালে। এনিয়াক[৩১] কম্পিউটারের বিকট বিকট ভ্যাকুয়াম টিউবগুলো নির্দ্বিধায় করে ফেলত হিসাবের হাজারো কাজ। তারপর উনিশশো ষাটের দিকে সলিড স্টেট মাইক্রো ইস্ট্রেনিক্সের[৩২] উদ্ভব। সে থেকেই প্রমাণ হয়ে যায় যে অন্তত মানুষের সমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলা সম্ভব। শুধু সময়ের প্রয়োজন। আর সে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে দেয়ার মতো জায়গা যে কোনো ছোট ডেস্ক বা টেবিলেই পাওয়া যাবে।
সম্ভবত কেউ জানত না যে, এ হিসাবটার আর প্রয়োজন নেই, উনিশশো আশির দিকে মিনস্কি আর গুড[৩৩] দেখান, কী করে নিউরাল নেটওয়ার্ক[৩৪] গুলোকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলা যায়। তারা সেই নেটওয়ার্কের স্বত:পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের রূপরেখাও তৈরি করার চেষ্টা করেন। বলেন যে এই সিস্টেম হবে মানুষেরই মতো ধীরে শেখা প্রোগ্রামযুক্ত, সে নিজে নিজে শিখবে।
কৃত্রিম মস্তিষ্ক মানুষের ব্রেনের চেয়ে অনেক দ্রুত অনেক বেশি তথ্য পাবে, শিখবে, জমা করবে। এর কাজের ধারা কখনোই বোঝা যাবে না। আর যদি যায়, তো সেটাও অন্য কোনো মেশিনের কাজ, কারণ এ ধারা মানুষের ব্রেনের ধারা থেকে লাখ গুণ জটিল হবে।
এর কাজ যেভাবেই হয়ে থাক না কেন, শেষ পরিণতি এই হাল। ফলে নতুনতর দর্শনের উদ্ভব হতে পারে, আসতে পারে নব দিগন্ত, যেখানে ‘শেখা’ শব্দটা আর ‘নকল করা’ কথাটার মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যাবে। এখানে মানব মস্তিষ্কের প্রায় সব কাজই করা হবে, তফাৎ শুধু গতিতে। এ এক খরচান্ত ব্যাপার, আর তাই হাল ন’হাজার সিরিজের মাত্র কয়েকটা মেশিন তৈরি হয়েছে।
হাল তার মানব সাথীদের তুলনায় কোনো অংশে কম ট্রেনিং নেয়নি কারণ তার কোনো বিশ্রামের দরকার নেই। তার নেই মানুষের মস্তিষ্কের মতো সীমিত স্মৃতি ভাণ্ডার। এখানে হালের আসল কাজ লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম মনিটরিং করা। সারাক্ষণ অক্সিজেন, বাতাসের চাপ, জাহাজের খোলের ছিদ্র, রেডিয়েশন চেকিংসহ ভঙ্গুর মানব ক্রুদের জন্য আর যা যা করা দরকার– সেসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে তাকে। সে জাহাজের দিকনির্দেশও দিতে পারে প্রয়োজনমাফিক। হাল হাইবারনেটরদের দেখাশোনা করে, পাঠায় তাদের জীবন-অমৃত-তরল।
প্রথম জেনারেশন কম্পিউটারের ইনপুটে দরকার ছিল টাইপরাইটার অথবা কীবোর্ড, আর আউটপুট আসত প্রিন্টার-বড়জোর মনিটরে। প্রয়োজনে এ সব সুবিধাই হাল নিতে পারে, কিন্তু তার যোগাযোগ হয় কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। বোম্যান আর পোল যখন খুশি হালকে মানুষ ভেবে কথা বলতে পারে। ইলেক্ট্রনিক ছেলেবেলার কয়েক হপ্তায় যে ইংরেজি শিখেছে সেই উচ্চারণে সে খুব সহজেই কাজ চালাতে পারে।