স্লিপ জেনারেটর চালু হওয়ার পর ইলেক্ট্রোডগুলো কপালে লাগানোর সাথে সাথেই সে কিম্ভুত কিছু আকৃতি দেখতে পায়, দেখতে পায় চলন্ত তারকা। তারপর সেগুলো মিইয়ে যায় এক সময়, আলোকহীনতা জাপ্টে ধরে অষ্টেপৃষ্ঠে। সে কখনোই ইঞ্জেকশনগুলো অনুভব করেনি, অনুভব করেনি শূন্যের মাত্র কয়েক ডিগ্রি উপরের শীতল তাপমাত্রা।
.
একসময় ডেভ বোম্যান জেগে ওঠে। জেগেই বুঝতে পারে, এইমাত্র তাকে শোয়ানো হয়েছে। কিন্তু সে জানত, এ এক মায়া; মিথ্যা ইন্দ্রজাল। বছর কেটে গেছে।
মিশন কি শেষ? তারা কি এখন শনিতে? কাজ শেষ করে ঘুমানোর পর ডিসকভারি-টু কি পৃথিবীর পথে তাকে বয়ে নিয়ে যাবে?
সে এক স্বপ্নময় ঘোরের দেশের বাসিন্দা। এখন আর সত্যি-মিথ্যা স্মৃতির কোনো তফাৎ করতে পারছে না। চোখ খোলার পর একদল মৃদুমন্দ আলোর ঝলক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। এ সামান্য আলোই বহুক্ষণ তন্দ্রাহত করে রাখে তাকে। এবার বোম্যান বুঝতে পারে তার চোখ একটা শিপ সিচুয়েশন বোর্ডের ইন্ডিকেটরে আটকে আছে। কিন্তু এত অসম্ভব। কয়েক মুহূর্ত পরেই ধারণাটাকে বাতিল করে দেয় নিজে নিজে।
উষ্ণ বাতাস বয়ে যাচ্ছে গায়ের উপর দিয়ে। শরীরের তন্ত্রে তন্ত্রে জমে থাকা শতাব্দীর শীতলতাকে টেনে বের করে দিচ্ছে। চারদিক সুমসাম। শুধু মাথার পেছনের কোনো স্পিকার থেকে ঐন্দ্রজালিক সুরলহরী খেলে চলেছে ক্যাপসুল জুড়ে। ধীরে ধীরে এর তীব্রতা বাড়ে, বাড়ে মধুর ঝংকার।
এরপর একটা শান্ত, বন্ধুভাবাপন্ন কণ্ঠ ভেসে আসে। বোম্যান জানে সেটা কম্পিউটার জেনারেটেড ভয়েস।
‘তুমি কার্যকর হয়ে উঠছ, ডেভ। উঠে বসো না। নড়াচড়ার কোনো প্রয়োজন নেই, কথা বলার চেষ্টা করোনা।’
‘উঠে বসো না!’ ভাবল বোম্যান। কী মজার কথা! একটা আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতাও তার নেই। ঠাণ্ডা ভাবটা কাটেনি এখনো।
একটু পরে সে বেশ সন্তুষ্ট হয়। সে জানে রেসকিউ শিপ অবশ্যই এসেছে। একমাত্র সান্ত্বনা, অটোম্যাটিক ট্রিগারে যেহেতু চাপ পড়েছে, খুব শীঘ্রই সে মানবজাতির সদস্যদের দেখবে। ব্যাপারটা চমৎকার, কিন্তু কেন যেন খুব একটা উৎফুল্প বোধ করে না।
এখন খিদেটাই মূল ব্যাপার। কম্পিউটার অবশ্যই ব্যাপারটা বোঝে।
‘ডান হাতের পাশে একটা বোম দেখতে পাবে, ডেভ। খিদে পেয়ে থাকলে কষ্ট করে চেপে দাও।’
নিজের আঙুলগুলো নড়ানোর চেষ্টা করতে করতে সে ডানে একটা বাল্ব দেখতে পায়। বেমালুম ভুলে গেছে এর কথা। কিন্তু এ নিয়ে অবশ্যই তার বিস্তর পড়াশোনা ছিল! আর কী কী ভুলেছে ও? হাইবারনেশন কি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্মৃতিও ধুয়ে দিয়েছে?
এবার সে বাটনটা চেপে ধরে। কয়েক মিনিট পর একটা ধাতব হাত বাঙ্ক দিয়ে প্রবেশ করলে প্লাস্টিকের নিপল নেমে আসে ঠোঁটের দিকে। ব্যগ্রভারে সেটা শুষে নেবার সময় বোম্যান টের পায় পুষ্টিকর উষ্ণ তরল তার ভিতরটাকে আরো সতেজ করে তুলছে।
নিপলটা চলে যাবার পর আবারো বিরামের পালা। এবার হাত-পা বেশ নাড়ানো যাচ্ছেতো! এখন হাঁটা আর কোনো অবাস্তব স্বপ্ন নয়।
যদিও তার শক্তি ফিরে আসছে বেশ তাড়াতাড়ি তবু একটা চিন্তা পীড়া দিতে শুরু করল। চিরকাল এখানে শুয়ে থাকতে হবে যদি বাইরে থেকে কেউ না ওঠায়।
এবার আরেক কণ্ঠ কথা বলছে। পুরোপুরি মানবিক কণ্ঠস্বর। আর কোনো ইলেক্ট্রনিক মেমোরি নয়, নয় মানুষের-চেয়েও-বেশি-কিছু। এ কষ্ঠ পুরোপুরি পরিচিত, কিন্তু কে বলছে তা বোঝা দায়।
‘হ্যালো, ডেভ। ঠিক হয়ে যাচ্ছ বেশ দ্রুত। এবার কথা বলতে পার। তুমি কি জানো কোথায় আছ এখন?’
সে এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মন খারাপ করে থাকে। যদি সত্যি সত্যি শনির চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে তো পৃথিবী ছাড়ার পরে এতগুলো মাসে কী হল? কবে ডিসকভারিতে উঠল? সব স্মৃতি কি শেষ? অ্যামনেসিয়ায়[২৯] ভুগছে নাতো? আবার বৈপরীত্য নিয়ে ভাবনা দেখা দেয়। যদি সে সহী-শুদ্ধভাবে অ্যামনেসিয়া শব্দটা মনে করতে পারে তো বাকী সব ভোলার যুক্তিটা কোথায়….
এখনো ডেভিড বোম্যান জানে না আসলে সে আছে কোথায়। কিন্তু সেপাশের কথক নিশ্চয়ই তার বেগতিক অবস্থা বুঝতে পারছে, ‘ভয় পাবার কিস্যু নেই, ডেভ। ফ্র্যাঙ্ক পোল বলছি। আমি তোমার হৃদপিণ্ড আর শ্বসন দেখছি। সব চলছে একদম ঠিকমতো। একটু বিরাম দরকার, বিশ্রাম নাও। এখুনি দরজা খুলে বের করে আনব তোমাকে।’
নরম আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চেম্বারটা। সামনে কিছু দেখতে পেল সে, সাথে সাথেই সবটুকু স্মৃতি ফিরে এল তড়িৎ গতিতে। এবার সে জানে ঠিক কোথায় আছে এখন।
ঘুমের দূরতম প্রান্তে আর মৃত্যুর নিকটতম সীমান্তে গেলেও কেটেছে মাত্র একটা সপ্তাহ। হাইবারনেকুলাম ছেড়ে যাবার পর শনির শীতল আকাশ দেখবে না, সেতো যোজন যোজন দূরে। সে এখনো গরম সূর্যের নিচে তপ্ত টেক্সাস শহরের হিউস্টন স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ট্রেনিং কোর্সের একজন সদস্য।
অধ্যায় ১৬. হাল
কিন্তু এখন টেক্সাস আর নেই। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের খোঁজ লাগানোও নিতান্ত কঠিন। লো থ্রাস্ট প্লাজমা ড্রাইভ কতদিন আগেইতো বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসকভারি আজো তার তীরের মতো শরীরটা নিয়ে পৃথিবীর দিকে পেছন দিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে। নিরন্তর। তার সব অপটিক্যাল যন্ত্র বাইরের দিকের প্ল্যানেটগুলোর দিকে তাক করা, যেদিকে তার লক্ষ্য।