ডিসকভারির জন্য এ এক ওয়ান ওয়ে জানি। তবু, এখনো এ মহাকাশ রথের ক্রুদের আত্মহত্যা করানোর কোনো মতলব আঁটা হয়নি। সব ঠিকঠাক চললে তারা ফিরবে আরো সাত বছর পর। এর মধ্যে পাঁচটা বছর চলে যাবে এক লহমায়, স্বপ্নহীন নিদ্রায়। এর নাম হাইবারনেশন, শীতন্দ্রিা। বাড়বে না বয়স তাদের। আসবে স্বপ্নের ডিসকভারি-টু। ঘুমের মধ্যেই তুলে নেবে তাদের দেবতার কল্পরথ।
‘উদ্ধার’ শব্দটা বেশ সতর্কতার সাথে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সব অ্যাস্ট্রোনটিক্স এজেন্সির ডকুমেন্ট আর বিবৃতি থেকে। এই শব্দটা পরিকল্পনায় কিছু দুর্বলতা দুর্বলতা ভাব এনে দেয়। তাই বৈধ শব্দটা হল, ফিরিয়ে আনা। আসলেই, বিপদ হলেই না উদ্ধারের প্রশ্ন। আর বিপদ যদি হয়েই যায় তো পৃথিবী থেকে বিলিয়ন মাইল দূরে উদ্ধারের আশা তো বহুদূর, প্রশ্নই ওঠে না।
অজানার প্রতি আর সব অভিযানের মতো এটাতেও কিছু হিসেবনিকেশ করে বের করে নেয়া হয়েছে ঝুঁকির বাস্তব পরিমাণটা। অর্ধ শতাব্দীর গবেষণা আজ হাইবারনেশনকে করেছে পরিপূর্ণ, এর ফলেই মহাকাশ অভিযানের নতুনতম অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুধু এ মিশন নয়, এর ফলে আরো অনেক মিশনের স্বর্ণদ্বার খুলেছে এই কল্পলোকের সোনার কাঠি-রূপার কাঠি।
সার্ভে টিমে আছে তিন সদস্য। এরা শনির চক্ৰবাকে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো কাজেই লাগবে না। তাই তাদের পুরো পথটায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে তাদের বয়স বেঁচে যাবে কয়েক মাস, বেঁচে যাবে টন টন খাবার আর দৈনন্দিন জিনিসপাতি। আরো বড় ব্যাপার হল, তারা দশ মাসের যাত্রা শেষে চরম বিরক্ত-অবসন্ন থাকবে না।
শনির একটা পার্কিং অর্বিটে ঢোকার তালে থাকবে ডিসকভারি। সে হবে দৈত্য গ্রহের নব অতিথি-উপগ্রহ। আজীবন ঘুরে চলবে বিশ লক্ষ মাইলের ডিম্বাকার পথ ধরে যেটা তাকে একবার শনির কাছাকাছি এনে ফেলবে, আরেকবার নিয়ে যাবে বেশ কয়েকটা উপগ্রহের পেছনে। কিন্তু তার আগে সে প্রথমে একটা চক্কর মারবে শনিকে। তারপর যাবে প্রত্যেক বড় উপগ্রহের অর্বিটে।
তাদের শত দিন পেরিয়ে যাবে পৃথিবীর চেয়ে আশি গুণ বড় দুনিয়া দেখতে দেখতে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মুখিয়ে থাকবে পনেরটা পরিচিত উপগ্রহ, কে জানে, আরো উপগ্রহ আছে কিনা! তাদের একটা আবার আকার আকৃতিতে খোদ শুক্রের মতো বড়।
সেখানে নিশ্চয়ই শতাব্দী ধরে দেখার মতো সুযোগ পড়ে আছে। প্রথম অভিযানটা স্রেফ আবছা আবছা ধারণা দেবে। এখানে যা পাওয়া যায় তার সবটুকুই পাঠানো হবে পৃথিবীতে। অভিযাত্রীদল না ফিরুক, তাদের কাজ ঠিকই ফিরে আসবে।
একশো দিনের কাজ শেষে ডিসকভারি থেমে যাবে। সব কু চলে যাবে হাইবারনেশনে। নিতান্ত দরকারি সিস্টেমগুলো থাকবে সক্রিয়। দেখভাল করবে শিপের ক্লান্তিহীন ইলেক্ট্রনিক ব্রেন। তারপর সে এমন এক অতি পরিচিত অর্বিটে ঘুরপাক খাবে যেখানে হাজার বছর পরেও মানুষ তাকে খুঁজে নেবে সহজেই। কিন্তু প্রয়োজন মাত্র পাঁচটা বছর, তারপর খবরদারির দায়িত্ব নিচ্ছে ডিসকভারি-টু। এমনকি যদি ছ-সাত বা আট বছরও লেগে যায়, ঘুমন্ত সৈনিকেরা যুদ্ধক্ষেত্রের নিষ্ঠুরতা টের পাবে না। কারণ এরিমধ্যে হোয়াইটহেড, কামিনস্কি আর হান্টারের জন্য ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে।
বোম্যান ডিসকভারির ফার্স্ট ক্যাপ্টেন। মাঝে মধ্যে সে নিজের তিন সহকর্মীকে নিতান্তই হিংসা করে। হাইবারনেকুলামের বরফ শীতল নীরবতায় থেকে ওরা আর সবকিছু থেকেই দারুণভাবে মুক্ত থাকতে পারছে। ওদের কোনো দায়িত্ব নেই, জেগে ওঠার পর নেই কোনো একাকিত্ব।
কিন্তু এই বাহ্যিক দুনিয়া তাদের তদারকিতে ব্যস্ত। পাঁচটা ক্যাপসুলে পাঁচ নাম বোম্যান, পোল, হোয়াইটহেড, কামিনস্কি আর হান্টার। প্রথম দুটি ক্যাপসুল মৃত। আরো বছরখানেকের মধ্যে জীবিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনটা ছোট্ট সবুজ বাতি সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রাখে; এর মানে-চিন্তা নেই, সব চলছে ঠিকঠাক। পাশে আছে খুদে ডিসপ্লে, সেই ডিসপ্লেতে দীর্ঘায়িত হার্টবিট, সামান্য পালসরেট আর সংকুচিত ব্রেন অ্যাকটিভিটি প্রকাশ পায়।
বোম্যান জানে, অপ্রয়োজনীয় একটা ট্রেনিং দেয়া হয়েছে তাকে। আদৌ এমন পরিস্থিতি হবে না। যদি কখনো বিপদ ঘটে, তো লাল বাতি জ্বলবে, অ্যালার্ম বাজবে, সে শুনতে পাবে অতি ধীর লয়ের হৃদস্পন্দন। এমনকি সেই স্ক্রিনের উপর রেখাগুলো কী বোঝায় তাও সে জানে ট্রেনিংয়ের বদৌলতে।
সবচে ঝকমারি আর মেজাজ গন্ধ করা ডিসপ্লে হল ই ই জি স্ক্রিন। তিন ব্যক্তিত্বের এক স্থির, ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষর। এটা একবারই স্থির হয়ে আছে, আবার চলবে তারা জেগে উঠলে। কিছুই যদি না দেখার থাকে তো কী দরকার ছিল এ জিনিসটা বসানোর? এখানে কোনো উঁচু-নিচু খাঁজ নেই। থাকবে কী করে, এটা জেগে থাকা মস্তিষ্কের অবস্থা বর্ণনা করে, বড়জোর স্বাভাবিক ঘুম। এ ঘুমে মস্তিষ্ক আদৌ কোনো উদ্দীপনা দেখাবে না। আর যদি কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ঘটেই, তা হবে যন্ত্র-এমনকি স্মৃতিরও অতীত।
শেষের ব্যাপারটা বোম্যান নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করেছে। মিশনের জন্য বেছে নেয়ার আগে তার হাইবারনেশন সক্রিয়তা মেপে দেখা হয়। সে বুঝতেই পারেনি জীবন থেকে একটা সপ্তাহ হারিয়ে গেল, নাকি সে সময়টা শুধুই শীতল মৃত্যুময় একটা অভিজ্ঞতা।