এরই এক অ্যান্টেনা সর্বক্ষণ খেয়াল রাখে দূরপ্রান্তে, সূর্যের কাছাকাছি। পৃথিবীর বুকে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টা অন্তর একটা করে পাঁচ মিনিটের রেডিও পালস সম্প্রচারিত হয়। ইলেক্ট্রিক মনিটর সারাক্ষণ যা দেখে তাই সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠিয়ে দেয়। আলোর গতিতে পনের মিনিট চলে তরঙ্গটা, পৌঁছে যায় ঠিকানামতো। সেখানকার মেশিন আর মেশিনম্যানরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকে। তারপরই এমপ্লিফাই করে নেয় তথ্যটুকু। রেকর্ড হয়ে যায় হাজার হাজার মাইল লম্বা ম্যাগনেটিক টেপের গায়। টেপগুলো আছে ওয়ার্ল্ড স্পেস সেন্টার (ডব্লিউ এস সি) এর ওয়াশিংটন, মস্কো আর ক্যানবেরার শাখাগুলোয়। আর মানুষের দুনিয়াবী যন্ত্র এ সব ব্যাপার নিয়ে চর্বিতচর্বণ চালাতে থাকে।
প্রথম স্যাটেলাইট বসানো হয় প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন, কোয়াড্রিলিয়ন কোয়াড্রিলিয়ন ইনফরমেশন পালস স্পেস থেকে অঝোর ধারায় ঝরছে সে সময় থেকেই। একটাই উদ্দেশ্য, মানুষের জ্ঞানটাকে আরেকটু এগিয়ে দেয়া। এসব বস্তাবন্দি জ্ঞান নিখুঁতভাবে দেখা হয়, তা না। এক মুহূর্তের কোনো বিশেষত্ব স্যাটেলাইটের চোখে পড়লেই যে তা মানুষের চোখে পড়বে, এমন নিশ্চয়তাও দেয়া যায় না। কিন্তু দশ, পঞ্চাশ বা শত বছর পর এ ডাটা কী কাজে লাগবে তা হয়তো এখন কল্পনা করাও অসম্ভব। সুবিশাল, প্রান্তহীন এয়ার কন্ডিশন্ড গ্যালারিতে তাই সারি সারি করে সব তথ্য জমা রাখা হয় পরম যত্নে। প্রতিটি তথ্যকে তিন কপি করে দেয়া হয় তিন সেন্টারে, নষ্ট হবার সম্ভাবনাকে পিছিয়ে দেয়া হয় আর একটু। এ হল পৃথিবীর সবচে দামী রত্ন, সমস্ত ব্যাংকের অযুত-নিযুত ভল্টে পড়ে থাকা অকর্মা সোনার তৃপের চেয়ে এর মূল্য অনেক বেশি।
আর এখন, ডিপ স্পেস মনিটর সেভেন্টি নাইন কোনো এক অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার লক্ষ্য করে ঘাবড়ে দিল সবাইকে। এক ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট বিশৃঙ্খলা সৌর জগতের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। অতীতে কখনোই এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায়নি। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটার দিক, সময়, প্রবণতা-সবকিছুই রেকর্ড করে নিয়েছে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খবরটা পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে।
অরবিটার এম ফিফটিন দিনে দুবার মঙ্গলকে চক্কর দেয়। সূর্যের পথে ঘুরে চলছে হাই ইনক্লাইনেশন প্রোব টুয়েন্টি ওয়ান। ওদিকে পুটোরও পেছনে শীতল আবর্জনার মাঝে বিচরণরত কৃত্রিম উপগ্রহের নাম আর্টিফিশিয়াল কমেট ফাইড। এটা এত বিশাল অর্বিট ধরে ঘুরছে যেটা একবার ঘুরে শেষ করতে তার হাজার বছরেরও বেশি সময় প্রয়োজন। সবাই এই অতি কিম্ভুত শক্তি-বিস্ফোরণ দেখতে পেয়েছে। এ শক্তিধারা সেসব মহাকাশ দানোর কারো কারো কলকজায় নাকও গলিয়েছে। সব্বাই নিজ নিজ খবর সময়মতো স্টোর করে রাখবে পৃথিবীর বুকে, তিনটি সেন্টারে।
কম্পিউটারগুলো হয়তো কখনোই চার দূরবর্তী স্পেস-প্রোবের ব্যতিক্রমী তথ্য পাচারকে আলাদা হিসেবে ধরতে পারবে না। কিন্তু সকালে চিরাচরিত রুটিনে চোখ বুলাতে গিয়েই গদারের রেডিয়েশন ফোর্সকাস্টার বুঝতে পারল গত চব্বিশ ঘণ্টার কোনো এক সময় সৌর জগতের মাঝে কিম্ভুত কিছু একটা ঘটে গেছে।
সে শুধু এর পথনির্দেশের সামান্য অংশ বুঝতে পেরেছে। কম্পিউটার এ পথকে প্ল্যানেট সিচুয়েশন বোর্ডের উপর স্থাপন করতেই দেখা গেল মেঘহীন আকাশে স্পষ্ট একটা চিকণ মেঘরেখা। কিংবা বলা যায় কোনো কুমারী বরফভূমিতে একদল অবাঞ্ছিত মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েছে। এনার্জির কোনো এক অবস্তুগত আকৃতি। যেন কোনো গতিময় স্পিডবোট থেকে ছলকে উঠছে রেডিয়েশন। এর শুরু চাঁদের মুখে।
শেষ তারার দেশে।
৩. গ্রহগুলোর মাঝে
তৃতীয় পর্ব : গ্রহগুলোর মাঝে
অধ্যায় ১৫. ডিসকভারি
শিপটা সবে পৃথিবী থেকে ত্রিশ দিনের দূরত্ব পেরিয়েছে; কিন্তু এখনি ডেভিড বোম্যানের মনে হয় যেন সে কোনোকালে এ একাকী দুনিয়া ছাড়া আর কোনো বিশ্বে ছিল না। এই একলা পৃথিবীর নাম ডিসকভারি।
তার ট্রেনিংয়ের সবগুলো বছর; চাঁদ আর মঙ্গলের বুকে করা আগের যত্তসব অভিযান, তার বাদবাকি সব স্মৃতি যেন অন্য কারো, অন্য কোনো জন্মের কথা।
ফ্র্যাক পোল একই মতবাদে বিশ্বাসী। সে মাঝেমধ্যেই আফসোস করে, এটা মনোরোগ। আর এর চিকিৎসক এখান থেকে শত মিলিয়ন মাইল দূরে বসে। কিন্তু এই একাকিত্ব একদম ন্যায্য, এখানে কোনো অসুস্থতার চিহ্ন নেই। কারণটা সোজা, মানুষের মহাকাশ বিচরণের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এমন অভিযানের একটা নমুনা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পাঁচ বছর আগে প্রজেক্ট জুপিটার আকারে এ মিশনের শুরু- গ্রহশ্রেষ্ঠের কাছে মানুষের প্রথম ধর্ণা দেয়ার চেষ্টা। দু-বছর ধরে শিপ প্রস্তুত হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ করেই মিশনের দিক বদলে গেল।
এখনো ডিসকভারি বৃহস্পতির দিকে যেতে পারে, কিন্তু থামবে না সেখানে। এমনকি বৃহস্পতি জগতের বিশাল উপগ্রহ-সাম্রাজ্যের কোথাও দৃষ্টিক্ষেপ করবে না মুহূর্তের জন্য, বরং গ্র্যাভিটিশনাল ফিল্ড কাজে লাগিয়ে নিজেকে সূর্যের কবল থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে অনেক অনেক দূরে। সে নিজেকে বানাবে একটা উল্কা, তারপর সৌর জগতের ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে এগিয়ে চলবে বাইরের এলাকায়, নিজের চরম উদ্দেশ্যে। আঙটি পরা শনিগ্রহ তার আরাধ্য। সে আসবে না আর ফিরে।