জ্বালামুখ এখনো দিনের আলোর ছোঁয়া পায়নি, অভাবটা পুষিয়ে দিচ্ছে। চারপাশের ফ্লাডলাইটগুলো। ঢাল বেয়ে কৃষ্ণমূর্তির দিকে এগুতে এগুতে ফ্লয়েড শুধু অসহায় বোধ করেনি, একটু ভয়ও পাচ্ছে। হাস্যকর ব্যাপার। কিন্তু তার ভাবনা অন্য। এই রহস্যের সমা কোনোদিন মানুষ করতে পারবে? তিন মিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা এখান দিয়ে গিয়েছিল। আর সে রহস্য এখনো স্থির, অবিচল। কীসের প্রতিক্ষায় আছে এটা?
চিন্তায় বাঁধা দিল স্যুট রেডিও, ‘প্রজেক্ট সুপারভাইজার বলছি, ডক্টর ফ্লয়েড, কয়েকটা ছবি তুলতে চাচ্ছি। একটু লাইন করে দাঁড়াবেন, প্লিজ? আপনি এই এখানটায়, মাঝখানে আসুন, ডক্টর মাইকেলস আসুন এদিকে…’
কেউ আশা করেনি ফ্লয়েড এখানেও মজার কিছু পাবে। কিন্তু যে ক্যামেরা এনেছে তার উপর সে মহাতুষ্ট। এ ছবি নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক হবে। সে তাই দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং ছবির কয়েকটা কপিও দাবী করেছে। আল্লা আল্লা করে হেলমেটের কাঁচের ভিতর দিয়ে চেহারা স্পষ্ট দেখা গেলেই হল।
‘থ্যাঙ্কস, জেন্টলমেন, বেসকে বলে দিব, সবাই কপি পাবেন।’
এবার ফ্লয়েড তার পুরো মনোযোগ দেয় নিরেট জিনিসটার উপর। পাক খায় চারধারে। তার মন কেন বোঝে না যে এরমধ্যে নতুন কিসসু পাওয়ার নেই। এ জিনিসের প্রতি বর্গ ইঞ্চি চষে ফেলা হয়েছে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে।
এবার শম্বুক গতির সূর্য দেখা দিল জ্বালামুখের উপরে। এর অকৃপণ কিরণধারার প্রথম ছোঁয়া বর্ষিত হচ্ছে কৃষ্ণগাত্রে। এখনো পুরো আলোটা যেন টেনে নিচ্ছে আলো খাদক জিনিসটা।
একটা ছেলেমানুষি পরীক্ষা করার জন্য ফ্লয়েড দাঁড়িয়ে যায় সূর্য আর টি এম এ ১ এর মাঝামাঝি। তার ছায়া কি পড়বে জিনিসটার গায়? এটা যেন সূর্যের দিকেই তাক করা। না, ছায়ার নামগন্ধও নেই। কমপক্ষে দশ কিলোওয়াট নগ্ন আলো পড়ছে স্ল্যাবের উপর। ভিতরে কিছু থেকে থাকলে সেটার কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাবার কথা।
কী অবাক ব্যাপার, আজ ফ্লয়েড এখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর ত্রিশ লাখ বছরের মধ্যে এ জিনিস সূর্যালোকে নেয়ে উঠেছে আজই প্রথমবারের মতো। পৃথিবীতে বরফ যুগ আসারও আগে এ জিনিস শায়িত ছিল ভূগর্ভে। কালো রঙটা একদম আদর্শ। আর সূর্যের আলো শুষে নেবার জন্যও উৎকৃষ্ট পথ। সাথে সাথেই নিজের চিন্তাটা বাতিল করে দিল ফ্লয়েড। এই ধারণা দিয়ে লোকহাসানোর কোনো মানেই নেই। কোনো ব্যাটা এত পাগল হয়েছে যে সৌর শক্তিতে চলা কোনো বস্তুকে বিশ ফুট মাটির নিচে দাবিয়ে রাখবে!
সে মুখ তুলে তাকায় পৃথিবীর দিকে। উপভোগ করে দিনের কিরণধারা। ছ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন এই অসাধারণ আবিষ্কারের খবর জানে। চূড়ান্ত খবরটা বেরুনোর পর পৃথিবীতে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে?
চিরকালীন সব ভাবনা কেমন দুলে উঠবে! মানুষ, তার রাজনীতি, তার সমাজনীতি, তার সবকিছু হয়ে উঠবে দোদুল্যমান। প্রত্যেকে, প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোক, যে নিজের আশপাশে একটু হলেও তাকায় সে তার নিজের জীবন, মূল্যবোধ, দর্শন- সবই গোড়া থেকে কেঁপে উঠতে দেখবে প্রকটভাবে। এমনকি যদি তেমন কিছুই না পাওয়া যায় টি এম এ-১ থেকে, তবু এ এক অসীম রহস্য হয়ে টিকে থাকবে। মানুষ অন্তত এটুকু জানবে যে সেই একক বুদ্ধিমত্তা নয়। এ জিনিস চিরকাল মানুষের অসাধারণত্বের অহংবোধে খোঁচা দিয়ে যাবে। তারা সহস্র প্রজন্ম আগের হলে কী হবে, ফিরে আসতেও পারে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে? ভালো, অন্য কেউ অবশ্যই থাকতে পারে অপার সৃষ্টিজগতের কোনো না কোনো কোণে। সারাটা ভবিষ্যৎ এই এক সম্ভাবনা বুকে নিয়ে বয়ে চলবে মানব সভ্যতাকে।
এসব ভাবনায় বেশ ডুবে ছিল ফ্লয়েড, কিন্তু এবারও বাগড়া দিল তার হেলমেট স্পিকার। অকল্পনীয় শক্তিশালী আর অপার্থিব শব্দ আসছে স্যুট হেলমেট থেকে। যেন চোখের সামনে কেউ চিরে দিল জগটাকে। শব্দটা অনেকটা ঘড়ির অ্যালার্মের মতো। সাথে সাথেই নিজের অজান্তে হেলমেটের উপর দিয়েই নিজের কানদুটো ঢেকে দেয়ার জন্য স্পেসস্যুট পরা হাত চেপে ধরে মাথার দুপাশে। এবার শব্দ কমানোর চেষ্টায় পাগলের মতো কোনো একটা সুইচ খুঁজছে ফ্লয়েড। দুলছে মাতালের মতো। একটু পরেই ক্ষমাসুন্দর নীরবতা নেমে এল চারদিকে। চারদিকের সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাক্ষসরাজ সোনার রথে চড়ে যাবার সময় পাথর করে দিয়ে গেছে আর সবাইকেও। তার মানে, আমার স্পেসস্যুটে কোনো সমস্যা হয়নিভাবে ফ্লয়েড। সবাই শব্দটা শুনেছে।
আর, ত্রিশ লক্ষ বছরের অমানিশা পার করে টি এম এ-১ স্বাগত জানালো।
স্বাগত জানালো চান্দ্র সূর্যোদয়কে।
অধ্যায় ১৪. শুনেছে যারা
শনির দশ কোটি মাইল পেছনের শীতল একাকিত্বে, যেখানে কোনো মানুষ কোনোদিন যায়নি, সেখানে ডিপ স্পেস মনিটর সেভেন্টি নাইন ধীর লয়ে ঘুরে চলেছে অস্টেরয়েড গ্রহাণুপুঞ্জের বেল্টের এবড়োখেবড়ো অবিটে। আপন মনে। তিন বছর ধরে এটা বেশ দক্ষতার সাথে আমেরিকান ডিজাইনার উদ্ভাবকদল, ব্রিটিশ নির্মাতা দল আর রাশিয়ান উৎক্ষেপণ বিজ্ঞানীদের সাফল্য ঘোষণা করছে। অ্যান্টেনার নাদুস-নুদুস জাল ছড়িয়ে থাকে এর চারপাশে। এগুলো সর্বক্ষণ চারদিকের সব বেতার তরঙ্গ, ভাঙনের শব্দ আর হিসহিসানি গলাধকরুণ করে। এই হিসহিসানিকেই অনেক বছর আগে প্যাস্কেল[২৭] বলেছিলেন ‘অসীম মহাকাশের নীরবতা’। গ্যালাক্সি বা আরো দূর থেকে আসা কসমিক রশিকে রেডিয়েশন ডিটেক্টরগুলো সব সময় রিসিভ ও অ্যানালাইজ করে। নিউট্রন আর এক্স রে টেলিস্কোপের দঙ্গল সব সময় এমন সব তারার উপর নজরদারি করে যেগুলো মানুষের চোখ দেখতে পায়নি কোনোকালে। ম্যাগনেটোমিটারগুলো সৌর বাতাসে হ্যারিকেনগুলোর ঘণ্টায় হাজার মাইল গতির বিশাল বিস্ফোরণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। দেখে নেয় সে সময়ে ঝড়ের মাঝখানে প্লাজমার ভয়াল খেলা। এই সব সহ আর যা ঘটে, তার সবকিছুর দিকেই ডিপ স্পেস মনিটর সেভেন্টি নাইন তার অক্লান্ত চোখ রেখেছে। সবটুকুই ক্রিস্টালাইন মেমোরিতে স্থান পায়।