জ্বালামুখে প্রবেশের সাথে সাথে সব যাত্রী একদম নিশুপ হয়ে গেল। আনন্দ আছে, আছে নিখাদ বিস্ময়, চাঁদ-মৃত চাঁদ তার বুকে এতবড় বিস্ময় লুকিয়ে রেখেছিল যুগ-যুগান্ত ধরে!
কালো স্ল্যাবের বিশ ফুটের মধ্যে এসেই বাস থেমে গেল। জিনিসটার আকৃতি একেবারে নিখুঁত জ্যামিতিক, সেটাতো জানা তথ্য, আরো কিছু দেখার বাকী রয়ে গেছে। এর অপ্রতিরোধ্য মসৃণ দেহের কোথাও কোনোরকম প্রতীক নেই, নেই চিহ্ন, কোনো প্রমাণ-কিছু নেই। এ যেন রাতের কঠিনীকৃত রূপ। আরো একটা তত্ত্ব কপচানোর চেষ্টা করে ফ্লয়েড, এটা চাঁদের জন্মের সময় গঠিত কোনো বিশেষ অস্বাভাবিক প্রাকৃতিকতার ফল নয়তো! তাইবা কী করে হয়, প্রকৃতি এমন নিখুঁত জ্যামিতিক হার হিসাব করবে কোনো দুঃখে? সবচে বড় কথা, এসব সম্ভাবনা আগেই ভেবে বাতিল করা হয়েছে।
জ্বালামুখের চারধারের ফ্লাডলাইটগুলো জ্বলে উঠতেই পরিবেশ পাটে গেল। চান্দ্র বায়ুশূন্য পরিবেশে আলোর কোনো রেখা দেখা যায় না। যদি বাতাস থাকত, ধূলিকণা যত্রতত্র ভেসে বেড়াতে পারত তাহলে অন্য কথা। চান্দ্র বায়ুমণ্ডল না থাকায় আলোর রেখাটা দেখা যায় না, শুধু দেখা যায় আলোর পতন।
আলোতে ভেসে গেছে চারদিক। দুধসাদা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সবার। সেই কালো গায়ে এবারো আলো পড়েছে, কিন্তু ফল সেই একই। যেন সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে অপার আগ্রহে।
প্যানডোরার বাক্স[২৬] নাকি এটা? ভাবে ফয়েড। চির আগ্রহী মানুষের মতোই সে ভিতরটা দেখতে চায়, কিন্তু কী লুকিয়ে আছে এর ভেতর? কে জানে?
অধ্যায় ১৩. ধীর সূর্যোদয়
টি এম এ-১ সাইটের মূল প্রেশার ডোম এপাশ-সেপাশে মাত্র বিশ ফুট হলেও লোকে লোকারণ্য। ভিতরটায় একদম গাদাগাদি করে বিজ্ঞানীরা বসবাস করে। দুটি এয়ারলক আছে এ ডোমে। প্রথমটির সাথে যুক্ত একটা বাস। বাসটা দারুণ কাজে লাগছে। সেটাই এক স্বর্গীয় শোবার ঘর এখন। অন্য এয়ারলক দিয়ে বাকীরা যাতায়াত করে।
গোলার্ধের মতো দেখতে এ প্রেশারডোম-বুদ্বুদগুলো। দেয়াল থাকে দুটি। ভিতরের ছয় বিজ্ঞানী প্রত্যক্ষভাবে প্রজেক্টের সাথে জড়িত। বুদ্বুদের ভিতরেই তাদের বেশিরভাগ যন্ত্রকে স্থান দিতে হয়েছে। রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা বা টয়লেটের আসবাবপত্রও ডোমের বিশাল অংশ জুড়ে থাকে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তাদের সাথে ঘুমাতে দিতে হয় জিওলজিক্যাল সার্ভের সব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রকে, যেগুলোর ভ্যাকুয়ামে নষ্ট হবার সম্ভাবনা প্রকট। সব সময় এখান থেকেই চোখ রাখা যায় টি এম এ-১ এর উপর। তবু, ভিতরে ছোট টিভি স্ক্রিন রাখতেই হয়েছে।
হ্যাভোরসেন ডোমের ভিতর থাকার সিদ্ধান্ত নিলে ফ্লয়েড একটুও অবাক হয়নি। সে নিতান্ত ভদ্রভাবেই নিজের কথা জানায়।
‘আমি স্পেসস্যুটকে একটা প্রয়োজনীয় শয়তান মনে করি।’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সাফ-সুতরো নিজের কথা জানিয়ে দেয়, ‘বছরে চারবার এই গন্ধমাদন পর্বত নিজের ঘাড়ে চাপাই। প্রতিবারই চেক-আউটে খোলা চাঁদে বেরুতে হয় আমাকে। ব্যস। তোমরা কিছু মনে না করলে আমি এখানে থেকেই টিভিতে সব দেখব।’
আজো কয়েকটা কুসংস্কারকে টেনে তোলা যায়নি। এখন আর স্পেসস্যুট কোনো গন্ধমাদন পর্বত নয়। কিন্তু সেসব বিজ্ঞানীর কেউ ব্যাপারটাকে বুঝতে পারবে না। প্রথম চান্দ্র অভিযানে যে জবরজঙ স্পেসস্যুট পরতে হয়েছিল তার তুলনায় আজকেরটা নস্যি। এগুলো গায়ে চাপাতে এক মিনিটও লাগে না। প্রয়োজন পড়ে না কারো সাহায্যের, এমনকি কোনো স্যুটতো অটোম্যাটিক। যে এম কে ফোরের ভিতর ফ্লয়েড নিজেকে এইমাত্র সিলগালা করে নিল সেটা চাঁদের চরম বৈরী পরিবেশ থেকেও তাকে বাঁচাবে নির্দ্বিধায়।
ডক্টর মাইকেলসের সাথে সে ঢুকে পড়ল এয়ারলকের ভিতরে। এবার, ছোট্ট বেসের শব্দ মিলিয়ে যেতেই নিজেকে সে আবিষ্কার করে চান্দ্র-শূন্যতার এক অসীম জগতে।
এই নীরবতায় চিড় ধরেছে তার স্যুট রেডিওর নাক-গলানো কথাবার্তায়।
‘প্রেশার ঠিক আছে তো, ডক্টর ফ্লয়েড? শ্বাস নিতে পারছেন ঠিকমতো?’
‘হ্যাঁ-একেবারে ঠিকমতো চলছে সবকিছু।’
অন্যদিকে মাইকেলস বাইরে থেকে সবকিছু দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘এবার যাওয়া যাক।’
আউটার ডোরটা খুলে যেতেই রুক্ষ প্রান্তর পৃথিবীর আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সামনে খোলা পথ।
লকের ভিতর দিয়ে বেশ কসরৎ করে ফ্লয়েড অনুসরণ করে মাইকেলসকে। কিন্তু আদৌ কসরতের কোনো প্রয়োজন নেই। হাঁটা একদম সহজ। কিন্তু এ স্যুট তাকে শুধু বাড়ি থেকে যোজন যোজন দূরত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়নি, বরং সময় থেকেও যেন এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা। এর বাড়তি ওজনটা একটু হলেও পৃথিবীর বুকে ওজনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এক ঘণ্টার মধ্যেই আশপাশের দৃশ্য অনেক বদলে গেছে। চোদ্দদিনের চান্দ্র রজনী ফুরিয়ে গেছে প্রায়। করোনার দ্যুতি যেন মিথ্যা কোনো দৃশ্য। সবাইকে চমকে দিয়ে মাথার উপর শত ফুট উঁচু রেডিও মাস্টটা জ্বলতে শুরু করল লুকানো সূর্যের প্রথম আলোয়।
প্রজেক্ট সুপারভাইজার আর তার দুই চ্যালা এয়ারলকের ভিতর থেকে বেরুনোর আগ পর্যন্ত ফ্লয়েড আর তার সহকর্মীদের অপেক্ষায় ছিল। জ্বালামুখে পৌঁছতে পৌঁছতে এক অসীম ক্ষমতাধর সূর্য উঁকি দিল পুব দিগন্তের পেছন থেকে। ধীরে ঘোরা চাঁদের এপাশটায় সূর্যের উঠে আসতে আরো ঘন্টাখানেক লাগবে, এরি মধ্যে আকাশের তারারা হাপিস হয়ে গেছে।