একটু স্যাম্পল তুলে আনার জন্য মাইকেলস আর তার সঙ্গীসাথীদের করা সব ভদ্ৰ চেষ্টাকেই বিফল করে দিয়েছে সেই অভদ্র কালো স্তম্ভটা। তাদের কোনো সন্দেহই নেই যে একটা লেজার বিম চালালে সহজেই জিনিসটাকে কাটা যায়, কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঐ ভয় ধরানো জিনিসের গা থেকে একটা চুল সরিয়ে আনতে পারেনি। এবার লেজার চালানোর মতো বড় সিদ্ধান্ত নির্ভর করে ফ্লয়েডের উপর।
এক্স রে, সনিক প্রোব[২৪], নিউট্রন বীম[২৫] এবং আর সব নিরাপদ পদ্ধতি আগে চেখে দেখা হবে। লেজারের ভারি গোলাবারুদ যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হবে তার পর। এ হল বর্বরের কাজ। তুমি কোনো জিনিসকে চিনতে পারছ না, সমস্যা কোথায়, ভেঙে দেখ! কিন্তু মানুষ সম্ভবত বর্বর জাতির সদস্য, গত শতাব্দীগুলোয় তারা সব সময় এ পথই অনুসরণ করেছে।
আর কোত্থেকে তারা এসে থাকতে পারে? স্বয়ং চাঁদের বুকে? না, এ একেবারে অসম্ভব। যদি এর বুকে একটাও প্রাণী থাকত তাও গত জ্বালামুখ-গঠন যুগে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। তখন চান্দ্র-উপরিতলের বেশিরভাগই ছিল আগুন-তপ্ত।
পৃথিবী থেকে সেই সভ্যতার শুরু নয়তো? খুবই বেখাপ্পা। কিন্তু হতেওতো পারে। কোনো অতি অগ্রসর পার্থিব প্রাণী-হয়তো তারা মানুষ নয়-প্লেইস্টোসিন এরার নিষ্ঠুর দিনগুলোতে…নাহ্! আরো হাজার প্রমাণ তারা রেখে যেত পৃথিবীর বুকে। চাঁদে আসার বহুদিন আগে থেকেই আমরা সে বিষয়ে সব জেনে ফেলতাম, ভাবে ফ্লয়েড।
আর মাত্র দুটি বিকল্প সামনে-গ্রহকুল আর নক্ষত্রলোক। এরি মধ্যে সৌর জগতের আর কোথাও সভ্যতার ছিটেফোঁটা থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি কোনো ধরনের জীবন থাকার সম্ভাবনাও নেই পৃথিবী আর মঙ্গল ছাড়া। ভিতরের গ্রহগুলো একদম গরম আর বাইরেরগুলো বরফশীতল। কোনো কোনোটার ভূমিতে আবার প্রতি স্কয়ার ইঞ্চিতে বায়ুচাপ শত শত টন, সেখানে জীবন গড়া অসম্ভব।
সুতরাং, এই পরিদর্শকদল হয়তো এসেছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি থেকে। এবার এটাতো আরো অসম্ভব মনে হচ্ছে। চাঁদের নগ্ন আকাশের দিকে খোলা চোখে সে তাকায়। কিছু একটা খোঁজে। তার মনে আছে কীভাবে মাঝেমধ্যেই তার বন্ধু বিজ্ঞানীরা ‘প্রমাণ’ দেখিয়েছে যে আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ অসম্ভব। আজো পৃথিবী থেকে চাঁদের দিকে যাত্রাটা দেখতে শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু সবচে কাছের তারকা হাজার লাখ গুণ দূরত্বে ঘুরপাক খাচ্ছে… আকাশকুসুম ভাবনাচিন্তায় ডুবে থাকা এখন সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আরো প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
‘দয়া করে আপনার সিটবেল্ট বেঁধে নিন এবং সব আলগা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন,’ হঠাৎ করেই কেবিন স্পিকার বলে উঠল, ‘সামনে চল্লিশ ডিগ্রি অবনমন।’
একেবারে দূরপ্রান্তে দুটি মার্কারপোস্ট দেখা যাচ্ছে। ফ্লয়েড কোনোমতে নিজেকে সামলে নিতেই বাসটা প্রবেশ করে খাড়া খাঁজের ভিতর। যেন কোনো ঘরের ঢালু ছাদ বেয়ে নেমে চলছে অনেকক্ষণ ধরে। এখন আর পৃথিবীর মিনমিনে আলো তেমন দেখা যাচ্ছে না। কারণ এই ঢাল। বাসের নিজস্ব ফ্লাডলাইট জ্বালতে হল। বহুবছর আগে ফ্লয়েড ভিসুভিয়াসের ঠোঁটের কাছে দাঁড়িয়েছিল। একেবারে জ্বালামুখের ভিতর। আজো সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ে গেল। তবে অনুভূতিটা খুব ঝেশ সুখদায়ক নয়।
ওরা টাইকোর ভিতরের কোনো এক সমভূমিতে নেমে যাচ্ছে। আরো কয়েক হাজার ফুট নিচে নেমে খাজ আবার উঠতে শুরু করবে। সামনের দিকে ঝুঁকে থেকে মাইকেলস মহোৎসাহে সমভূমি দেখাচ্ছে।
‘এইতো, সামনে।’ যেন নতুন কোনো বিস্ময়ের কথা শোনাচ্ছে সে। মাথা ঝাঁকায় ফ্লয়েড, কয়েক মাইল দূরের সবুজ আর লাল বাতিগুলো তার চোখে পড়েছে আরো আগেই। যদিও এই দানো-যানটা ভালোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, তবু স্বভাব অনুযায়ী ফ্লয়েড সমভূমিতে নেমে যাবার আগ পর্যন্ত স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারেনি।
এবার পৃথিবীর আলোয় রূপালী বুদবুদের মতো চকচক করতে থাকা দুটি প্রেশার ডোম তার চোখে পড়ে। সাইটে কাজ করার মানুষের জন্য এগুলো তাঁবুর কাজে দেয়। কাছাকাছিই একটা রেডিও টাওয়ার, একটা ড্রিলিং রিগ, প্যাকেট করা বেশ কয়েকটা যানবাহন, আর বেশ বড় একটা খণ্ড পাথরের স্তূপ। একাকিত্বের মাঝে এই ছোট্ট ক্যাম্পটা দেখে বেশ দুঃখী মনে হয়। চারপাশে প্রকৃতির জমকালো নিষ্ঠুরতা। সেখানে নেই জীবনের কোনো চিহ্ন। বাইরে থেকে দেখে কেন যে মানুষ এখানে এসেছে তা বোঝাই যাবে না।
মাইকেলস বলছে, ‘যদি পাহাড়ের উপর যাও, ঐ রেডিও অ্যান্টেনার দিকে শ’খানেক গজ গেলে শুধু জ্বালামুখই দেখতে পাবে।’
তো, এই হল সেই আতঙ্ক! ভাবল ফ্লয়েড। এখন বাসটা প্রেশার ঢোমকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। সামনেই জ্বালামুখের ঠোঁট। একটু ভালোভাবে দেখার জন্য সে এগিয়ে গেল সামনে, সাথে সাথেই বেড়ে যাচ্ছে হৃদস্পন্দন। এখন বাহনটা এক বিশাল আধভাঙা পাথরে ওঠার পাঁয়তাড়া করছে। পাথরটা অগ্নিজ্বালামুখের ভিতরে। এবং সাথে সাথেই ঠিক সেসব ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল টি এম এ-১।
ফ্লয়েড একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, মিটমিট করে চোখদুটো, একটু নাড়ে নিজের মাথা, আবার তাকায় অপলক নেত্রে। এই তীব্র ধরণী জোছনাতেও জিনিসটাকে দেখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রথমে মনে হয় যেন কার্বন পেপার থেকে কেটে তোলা এক সমতল চতুষ্কোণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন এর কোনো ঘনতুই নেই। অবশ্যই, এ এক দৃষ্টি বিভ্রম। এটা কঠিন বস্তু হলেও এর আলোক-প্রতিফলন এতই কম যে জিনিসটাকে না দেখে বরং এর আশপাশের আলোয় ভেসে যাওয়া এলাকা দেখে এর উপস্থিতি বুঝতে হচ্ছে।