বাইরে তাকিয়েই ফ্লয়েড দেখতে পায় সার ধরে পড়ে আছে কত ঝকমারি যানবাহন। প্রতিটিতেই একটা করে ফ্ল্যাশলাইট আছে, আছে ট্রেইল, সেই পথেও ফ্ল্যাশলাইট বসানো। দূরত্বটা দু’শ কিলোমিটার হলেও এই রাতে কেউ ক্ল্যাভিয়াস বেস থেকে টি এম এ-১ এর পথে যেতে চায় তাহলে হারিয়ে যাবে না।
মাথার উপরকার তারার দল একটু উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। নিউ মেক্সিকো বা কলোরাডোর ঝকঝকে আকাশ থেকেও নক্ষত্রলোক এত সুন্দর দেখা যাবে না। কিন্তু ঐ কয়লাকালো আকাশে এমন দুটি জিনিস আছে যা পৃথিবী-পৃথিবী ভাবকে পুরোপুরি উবিয়ে দেয়।
প্রথমটি ধরিত্রী স্বয়ং-উত্তর প্রান্তে আলোকবর্ষী এক গোলক সে। পূর্ণ চন্দ্র যত আলো বর্ষাতে পারে তারচে অর্ধশতগুণ আলো ঝরাচ্ছে আধ-পৃথিবী। পুরো ভূমিই যেন কিম্ভুত নীলচে সবুজ আলোর জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে পুব আকাশে কৌণিকভাবে জ্বলতে থাকা ক্ষীণ আলোকমালা। এটা আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসছে। এই হল সেই অদ্ভুতুড়ে মহিমা যা কোনো মানুষ পৃথিবীতে বসে দেখার কথা কল্পনাও করতে পারে না। এই হলো করোনা, চান্দ্র সূর্যোদয়ের পূর্বসূরী। এ বহুক্ষণ ধরে বলে যায় যে মহান সূর্য একটু পরে চন্দ্রদেবের ঘুম ভাঙাবেন।
যাত্রীদের অবজার্ভেশন লাউঞ্জটা পাইলটের সিটের ঠিক পেছনে। হ্যাভোরসেন আর মাইকেলসের সাথে অবজার্ভেশন লাউঞ্জে বসেই সে দেখল তার ভাবনার জগৎ বারবার দোল খেয়ে যাচ্ছে। তিন মিলিয়ন বছরের পুরনো উপসাগরটা এই মাত্র তার সামনে নিজের পুরো বিস্তৃতি নিয়ে হাজির হল। আর সব অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীর মতো ফ্লয়েডের চিন্তাও ঘুরেফেরে আরো বেশি বছরের আশপাশে। ত্রিশ লাখ বছর ইউনিভার্সের তুলনায় কিছুই নয়। তবু সেসময়ে কিছু তৈরি হয়নি। মন না, ভাবনা না, তৈরি হয়নি কোনো পরিণত মস্তিষ্ক।
ত্রিশ লাখ বছর! অসীম যেন তার বিস্তৃত ছবিকে তুলে আনল সামনে। লিখিত ইতিহাস, ইতিহাস কাঁপানো সেসব যুদ্ধবাজ নৃপতি, বিশ্বের প্রগতি আনন্দ-বেদনা, এই বিশাল সময় সাগরের হাজার ভাগের একভাগকেও ভরিয়ে তুলতে পারছে না। মানুষতে মানুষই, আজকের পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণীই সেদিন ছিল না যেদিন চাঁদের বুকে বড্ড যত্ন করে এই কালো কিংবদন্তীকে কবর দেয়া হয়। কবর দেয়ার জায়গাটাও খুব হিসেব করে বের করা, চাঁদের সবচে উজ্জ্বল আর সবচে অদ্ভুত জ্বালামুখ!
এটাকে যে পুঁতে দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে ডক্টর মাইকেলস একেবারে নিশ্চিত।
‘প্রথমে,’ মাইকেলস ব্যাখ্যা করে, ‘আমি ধরে নিই যে এটা কোনো লুকায়িত জিনিস নির্দেশ করছে। কিন্তু আমাদের সর্বশেষ অভিযানে এর উল্টো ফল বেরোয়। জিনিসটা বসে আছে একই বস্তুতে তৈরি প্ল্যাটফর্মের উপর। তার নিচে নিরেট পাথর। এর… স্রষ্টারা… জানত যে একে টিকে থাকতে হবে চাঁদের সব ভূকম্পন সয়ে গিয়ে। তারা জিনিসটাকে বসিয়েছিল অসীম সময়ের জন্য।’
মাইকেলস এখনো হতাশা আর আশার মিশ্রিত সুরে বলে যায়, ফ্লয়েড দু অনুভূতিকেই প্রবাহিত করে নিজের ভিতর। শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রাচীনতম প্রশ্নের মধ্যে একটার জবাব মিলেছে। এই একমাত্র সভ্যতা নয়; ইউনিভার্স আরো বুদ্ধিমত্তার জন্মদাতা। একই সাথে সময়ের ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। যাই এখান দিয়ে গিয়ে থাক না কেন, সেটা মানব সভ্যতাকে হাজায়ো প্রজন্মের ব্যবধানে না দেখেই চলে গেছে। আর আমরা তাদের সম্পর্কে আজ হঠাৎ করে কীই বা জানব, যারা আকাশ ভেদ করে চলে গেছে সেই যুগে যে যুগ আমাদের পূর্ব পুরুষদের বাস করাতো গাছের ডালে ডালে।
চাঁদের অতি ছোট দিগন্তের কাছাকাছি একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে সিলভার ফয়েলে মোড়া একটা তাঁবুর মতো জিনিস সেদিকে। অবশ্যই সেই ফয়েলটা দিনের অসভ্য আলোর বিরুদ্ধে কাজে দেয়। বাস চলা শুরু করলে ফ্লয়েড শক্তিশালী দিনের আলোয় পড়তে পারে:
ইমার্জেন্সি ডিপো নং-৩
বিশ কিলো লক্স[২৩]
দশ কিলো পানি
বিশ ফুডপ্যাক এম কে ফোর
এক টুলকিট (টাইপ বি)
এক সট রিপেয়ার আউটফিট
টেলিফোন!
‘এ নিয়ে ভেবেছিলে কিছু?’ প্রশ্ন করে ফ্লয়েড, জানালার বাইরে তার হাত নির্দেশিত, ‘ধরো জিনিসটার সাপ্লাই ফুরিয়ে গেল, তখন?’
‘এমন সম্ভাবনা আছে,’ স্বীকার করে মাইকেলস, ‘সেই ম্যাগনেটিক ফোর্সটি হঠাৎ করেই আবার ঠিক হয়ে যায়। ফলে গোলযোগের সামান্য এলাকাটা পাওয়া কোনো নাভিশ্বাস তোলার মতো কষ্টের ব্যাপার না। আর ম্যাগনেটিক বিশৃঙ্খলার এলাকাটা নিতান্তই ঘোঁট। বেশি সাপ্লাইয়ের দরকার পড়ে না।’
নাক গলায় হ্যাভোরসেন, কেন নয়? কে জানে তারা কত বড় ছিল? হয়তো তারা ছিল ছয়ইঞ্চির লিলিপুট, এটা তাদের কাছে ত্রিশতলার বিল্ডিংয়ের সমান হবে।
মাইকেলস উত্তেজনায় নিজের হাত নাড়ে, ‘আউট অব কোশ্চেন। বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য ন্যনতম একটা মস্তিষ্ক আকুতি প্রয়োজন।’
মাইকেলস, হ্যাভোরসেন আর ফ্লয়েড-তিনজনেই বলে যায় নিজের নিজের কথা, গুরুত্ব দিয়ে শোনে অন্যের মতামত। কিন্তু একটু ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বও যেন ধরা দিচ্ছে তাদের কথায়।
একটা ব্যাপারে তাদের মতভেদ নেই, তা হল টি এম এ-১ বা টাইকো মনোলিথ। সব রহস্য এর ভিতর লুকিয়ে আছে। চাঁদে নামার পর গত ছ’ঘণ্টায় ফ্লয়েড অন্তত বারোটা থিওরী শুনেছে। কিন্তু তার নিজের কোনো তত্ত্ব নেই। ধর্মমন্দির, প্রাচীন সমাধি, রত্নভাণ্ডার, সার্ভে মার্কার, জিওফিজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট-আরো কত কী! কোনো কোনো মৌলবাদী’ একরোখা বিজ্ঞানীর কথাবার্তা আরো ভয়াল। অনেক বাজী ধরা হয়েছে এরি মধ্যে, আর সত্যিটা বেরিয়ে পড়লে হাতবদল হবে বেশ বড়মাপের কারেন্সি। অবশ্য একটা কথা থেকে যায়, আদৌ সত্য উদ্ঘাটন হবে তো!