একেবারে গোবেচারা চোখেও এটুকু ধরা পড়বে যে, চাঁদের এ অংশের চৌম্বকক্ষেত্রে কোনো একটা গণ্ডগোল চলছে। সেই মানচিত্রের একেবারে নিচে বড় অক্ষরে লেখা: টাইকো চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা–এক (টি এম এ-১)। এর একেবারে কোণায় স্পষ্ট করে লিখে দেয়া আছে, ‘অত্যন্ত গোপনীয়।
‘প্রথমে আমরা ধরে নিলাম এটা কোনো বহির্জাগতিক শিলার কাণ্ড। কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ এর বিপরীতে যাচ্ছে। অগত্যা একটু চোখ বুলাতেই হলো।’
‘প্রথম দল কিস্য আবিষ্কার করতে পারেনি। এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, স্বাভাবিক লেভেলটা চাঁদের মাটির একটু ভিতরের দিকে দেবে যায়। ওরা একটা ড্রিল দিয়ে ঠিক মধ্যখানে খোঁড়া শুরু করেছিল স্যাম্পলের আশায়। বিশ ফুট নিচে ড্রিলটা থেমে গেল। তারপরই সার্ভে পার্টি খননকাজ শুরু করে, স্পেসস্যুটের ভিতরে থেকে কাজটা বেশি সুবিধার না, আপনাদের এটুকু বলতে পারি।
‘যা পেল তা নিয়েই তড়িঘড়ি করে ফিরে এল বেসে। ভালো ইকুপমেন্টসহ একটা বড় দল পাঠালাম এবার। এবারের যুদ্ধ চলল দু হপ্তা ধরে। ফলাফল আপনারা জানেন।’
স্ক্রিনের ছবি বদলের সাথে সাথে অন্ধকার কনফারেন্স রুমের পরিবেশও বদলে গেল। প্রত্যেকেই বহুবার দেখেছে দৃশ্যটা, তবু নতুন কিছু পাবার আশায় সবার চোখ স্থির হয়ে রইল ছবির উপর। গোটা পৃথিবী আর চাঁদের মধ্যে একশোজনও এ ছবির উপর চোখ ফেলার অনুমতি পায়নি।
উজ্জ্বল লাল আর হলুদ স্পেসস্যুট পরা এক অভিযানকারী কোনো এক খননকৃত এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটা অবশ্যই রাতের। চাঁদ বা মঙ্গলের যে কোনো স্থানে এমন দৃশ্য দেখা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও কোনো গ্রহে কোনোদিন এমন একটা দৃশ্যের অবতারণা হয়নি।
যে বস্তুর সামনে স্যুট পরা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সেটা এক মিষমিষে কালো স্ল্যাব। উচ্চতায় মোটামুটি দশফুট আর প্রস্থে পাঁচ। এক পলক দেখেই সুবিশাল কবরফলকের কথা মনে পড়ে যায় ফ্লয়েডের। একেবারে নিখুঁত পালিশ করা। মনে হয় সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে। কোনো খুঁত নেই উপরিতলের। কী দিয়ে তৈরি তা বলারও যো নেই। হতে পারে পাথর, প্লাস্টিক, অথবা ধাতু…অথবা মানুষের অজানা কোনো উপাদানও হতে পারে।
‘টি এম এ-১,’ ডক্টর মাইকেলস দরাজ গলায় ঘোষণা করে, ‘এটাকে দেখে ব্র্যান্ড নিউ মনে হয়, তাই না? আসলে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না যারা বলবে এ জিনিস বড়জোর বছর কয়েকের পুরনো। কেউ আবার এটাকে আটানব্বইয়ের তৃতীয় চৈনিক অভিযানের সাথে গুলিয়ে ফেলার পাঁয়তারা ভাজছে। কিন্তু আমি কশিনকালেও সেসব কথায় কান দিইনি-আর এবার আমরা এর বয়স নিয়ে একটু মাতামাতি করতে পারি। তথ্যসূত্র? স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো।
‘ডক্টর ফ্লয়েড, আমার কলিগরা আর আমি আমাদের সারা জীবনের সব সুনাম এর উপর বাজী লাগাতে রাজী। টি এম এ-১ এর সাথে চাইনিজদের কোনোকালে কোনো সম্বন্ধ ছিল না। বলতে গেলে, এর সাথে মানবজাতির আদৌ কোনো সম্বন্ধ নেই। কারণ, যখন এটাকে কবর দেয়া হয় তখন মানুষ বলতে কিছু ছিল না।
‘দেখতেই পাচ্ছেন, এটা তিন মিলিয়ন বছরের পুরনো। ত্রিশ লাখ সাল পেরিয়ে গেছে। এখন, দ্রমহোদয়গণ, আপনারা যেটার দিকে তাকিয়ে আছেন তা হল পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমত্তার প্রথম প্রমাণ।’
অধ্যায় ১২. ধরণী-জোছনায় যাত্রী
ম্যাক্রো ক্র্যাটার প্রভিন্স: এস এর মতো একটা অংশ বেরিয়ে আছে সবচে সামনের জ্বালামুখ থেকে। চাঁদের দৃশ্যমান অংশে অবস্থিত। ই এর মতো বেরিয়ে থাকে সেন্ট্রাল ক্র্যাটার প্রভিন্স থেকে। এখানে-সেখানে হাজারো জ্বালামুখ। এখানেই চাঁদের সবচে বড়টা সহ অনেক বড় বড় অগ্নিগিরিমুখ রয়েছে। এন এর মতো দেখতে অংশটায় কিছু প্রভাবশালী জিনিসপত্র চোখে পড়ে। বেশিরভাগ মুখই একটু খাড়া। কোনো কোনোটা দশ ডিগ্রি থেকে বারো ডিগ্রি। কোনো কোনোটার তলদেশ একেবারে সমতল।
নামা ও নড়াচড়া এবড়োথেবড়ো ভূমির কারণে ল্যান্ড করাটা কষ্টকর হবে। বরং সমতল জ্বালামুখের কোনোটায় নামলে সবচে বেশি সুবিধা হতে পারে। যে কোনো ধরনের মুভমেন্ট সহজ হবে, কিন্তু আগে থেকেই পথ নির্দিষ্ট করে রাখা দরকার। এক্ষেত্রেও সমতল জ্বালামুখের তলদেশে নড়াচড়া সুবিধাজনক।
গঠন: এখানে গঠন করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ প্রচুর আলগা পাথর ও পাথরের চাই পড়ে থাকে। এক্ষেত্রেও সমতল জ্বালামুখের তলদেশ সুবিধাজনক।
টাইকো: পোস্ট-মারিয়া জ্বালামুখ। ব্যাসে চুয়ান্ন মিটার। পরিধি সাত হাজার ন’ শ ফুট, তলা বারো হাজার ফুট নিচে। চাঁদের মধ্যে টাইকো রে সিস্টেম সবচেয়ে ভাল। এ থেকে পাঁচশো মাইলেরও বেশি দূরে আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দেয়া যায়।
(চাঁদের উপরিতলে বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং সমীক্ষা’ অফিস, চিফ অফ ইঞ্জিনিয়ার্স, ডিপার্টমেন্ট অফ দ্য আর্মি-ইউ এস, ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ওয়াশিংটন, উনিশশো একষট্টি-থেকে নেয়া।)
এখন ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল এলাকা চষে ফেলছে মোবাইল ল্যাব। জ্বালামুখের দিকে তোলাপাড় করে এগুচ্ছে আট চাকার বিশালদেহী ল্যাবরেটরিটা। দেখতে ছোটখাট একটা বেসের মতো। এর ভিতর বিশজন মানুষ হপ্তার পর হপ্তা আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারে। বলা যায়, এ হল এক ভূমিতে চলা পরিপূর্ণ স্পেসশিপ। প্রয়োজনে উড়তেও জানে এ বিশেষ যানটি। কারণ নিচে আছে শক্তিশালী চারটি আন্ডারজেট।