সুতরাং, আমাদের কাহিনীটা লিখতে অনেক ঘাম ঝরাতে হল। এমন কিছু লিখতে হবে যেটা বাস্তবের নির্যাসে সিক্ত থাকবে না শুধু, বরং তাই হবে বাস্তব। আবার সেই বাস্তবটা পরের ক’বছরের মধ্যে হলে চলবে না।
আমাদের প্রথম টাইটেলটা ছিল: কীভাবে সৌরজগৎ বিজিত হল। কিন্তু স্ট্যানলি সোজা কথায় একটা অভিযানের বাইরের রূপ বলে দিতে চাননি। তাছাড়া তিনি আমাকে সারাক্ষণ যে কথাটা বলে মজা পেতেন, তা হল, ‘আমি পৌরাণিকতার ঘ্রাণ নিতে ভালবাসি…’
কিন্তু, আজ ২০০১ এই একটু সামনে। হয়তো সে কারণেই ছায়াছবিটা সাধারণ্যে এক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আমার বড় সন্দেহ হয়, তার সবচে বড় স্বপ্নগুলোতেও স্ট্যানলি কখনো কি ভেবেছিলেন যে একটা সুপার বল খেলার ঘোষক যখন ত্যালত্যালে কণ্ঠে বলবে, ‘ইট ওয়াজ এ বাগ, ডেভ। তখন টিভির সামনে বসা দশ কোটি আমেরিকানই সাথে সাথে চিনতে পারবে ঠিক কে (বা কোন জিনিসটা…) কাকে কখন এ কথাটা বলেছিল।
আরো একটা ব্যাপার, আই বি এম তার এক মেশিনের নামকরণ যখন সেই পুরনো হাল এর সাথে মিলিয়ে রাখে তখনো স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হতে হয়। যোড়শ অধ্যায়ে পুরো নামটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
যদি পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখতে চান তো আপনাদের সেই চমৎকার ভয়েজার ক্রাইটেরিয়ন ডিস্ক দেখার কথা বলব। পুরো মুভিটাতো আছেই, সেই সাথে তৈরির সময়ের ব্যাপারগুলোও দেয়া আছে সেখানে। ছবি শু্যট করার সময়ে বাড়তি দৃশ্য সহ বিজ্ঞানী, শিল্পী, টেকনিশিয়ানদের সাক্ষাৎকারও আছে। সেখানে একজন মোটামুটি তরুণ আর্থার সি ক্লার্কের সাক্ষাৎকারের দৃশ্যও আছে। চাঁদের সেই কনফারেন্স রুমে নেয়া হয়, চারপাশে মুভিতে ব্যবহার করা এমন সব জিনিস ছিল কিছুদিন পরেই যেগুলো চাঁদের বুকে বিশ্রাম করার সুযোগ পায়। ব্যাপারটা শেষ হয় আরো বিরক্তিকর কিছু দৃশ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে আসা অ্যাপোলো, স্কাইল্যাব সহ অন্যান্য শাটলের সাথে স্ট্যানলির স্বপ্নের কাজের মিল দেখানো হয় পাশাপাশি তুলনা করে।
আমার কাছে ব্যাপারটা তেমন অবাক করা নয়, চলচ্চিত্রের সাথে বইটির মিল নেই, এ দুয়ের সাথে বাস্তবতার তেমন মিল নেই এবং বাস্তবতার সাথে পাল্লা দিয়ে আরো হাজারটা চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি তৈরি হচ্ছে। তাই আমি একেবারে শুরুতে ফিরে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা কোত্থেকে শুরু হল তা আরেকবার মনে করতে চাই।
১৯৬৪’র এপ্রিলে আমি সিলন ছেড়ে গেলাম। সেকালে এ নামেই ডাকা হত জায়গাটাকে। তারপর নিউইয়র্কে সময় ও জীবদ্দশা নিয়ে লেখা ম্যান এন্ড স্পেস বইটার এডিটিং শেষ করার কাজে ঝুঁকেছিলাম। সেখানকার একটা কথা তুলে দেয়ার লোভ সামলে উঠতে পারছি না।
.
সিলনের ভূ-স্বর্গে বেশ ক’বছর কাটানোর পর আবার নিউইয়র্কে ফিরে আসাটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। আই আর টি’র মাত্র তিনটা স্টেশনে ঘুরে বেড়ানোও আমার জন্য মহা ব্যতিক্রম এবং ভালো একটা রিল্যাক্স। বিশেষত দিনগুলো যেখানে কাটত হাতির দলে, প্রবাল রিফে, নানা রঙের মৌসুমে ঘুরে বেরিয়ে ডুবে যাওয়া পুরনো দিনের জাহাজের সাঁতার কেটে হরদম দিন কেটে যেত। অন্যদিকে আজব চিৎকার, হাস্যোজ্জ্বল হাজার মুখ, রহস্যময় সম্পর্কের পথে ম্যানহাটানীয়দের একেবারে নিপাট ভদ্র ব্যবহার বিমোহিত করে মুগ্ধতার অন্য অংশকে; তেমি অবাক করে কোমল হুইসেল বাজাতে বাজাতে দিক-চিহ্নহীন সাবওয়ে স্টেশনে ছুটে চলা বজ্রগতির রেলগাড়িগুলোে, বাহারি বিজ্ঞাপন (কোনো কোনোটা আবার অপেশাদার আর্টিস্ট গুবলেট করে ফেলেছে, সেই কাঁচা হাতের কাজও মানিয়ে যাচ্ছে কেমন করে যেন) অযুত রঙে ঝকমক করছে কতশত ব্র্যান্ডের নাম নিয়ে-দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট, লেভি’স ব্রেড, পাইল’স বিয়ার, আর মুখের ক্যান্সার উৎপাদনে মহা কার্যকর ডজনখানেক ব্র্যান্ডের কামড়া-কামড়ি। মজার ব্যাপার হল, একটা ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে আপনার মিনিট পনের সময় লাগবে, ব্যস। এবং একই সময়ে সেটা মিলিয়ে যাবে মন-মগজ থেকে। (রিপোর্ট অন প্ল্যানেট থ্রি থেকে ‘সন অব ড. স্ট্রেঞ্জলাভ’)
.
ম্যান এন্ড স্পেসের উপর আমার কাজ ভালোভাবে এগুনোর সময়টায় সময় আর জীবন নিয়ে কাজের প্রতি ঈর্ষান্বিত এক সমালোচক বলেছিলেন, ‘এই জবানি দেয়ার অধিকার আপনার আছে? কোথায় সেটা?’
আমি মহিলার দিকে সর্বস্ব ভস্ম করে দেয়া একটা দৃষ্টি হেনে বললাম, ‘আপনি তার দিকেই চেয়ে আছেন।’
সুতরাং, স্ট্যানলির সাথে জোছনা উপভোগ করার মতো সময় আমার হাতে ছিল এবং বেশ ভালোভাবেই ছিল। তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ট্রেডার ভিক-এ। (তাদের উচিত জায়গাটাকে চিহ্নিত করে রাখা) স্ট্যানলি তখনো তার শেষ ছবি ড, স্ট্রেঞ্জলাভ নিয়ে সোয়াস্তির জাবর কাটছেন এবং আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রজেক্টের ধারণা পাবার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তার লক্ষ্য আরো বড়, ইউনিভার্সে মানুষের অবস্থান নিয়ে কিছু একটা করে দেখানোর ইচ্ছা তাঁর। এমন কিছু করা যার ফলে পুরনো বা নতুন স্কুল শিক্ষকদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
স্ট্যানলি এমন এক লোক, যিনি যে কোনো বিষয় মাথায় আসার সাথে সাথে সেটাতেই একেবারে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতেন। সকল কাজের মহাকাজি। ততদিনে বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কয়েকটা লাইব্রেরি তিনি হজম করে বসে আছেন। এর মধ্যেই একটা সম্পদের স্বত্ব কজা করে নিয়েছেন যেটাকে বলা হয় ‘শ্যাডো অন দ্য সান। আমার মনে পড়ে, তিনি লেখাটা নিয়ে কিছু বলতে পারেননি এমনকি এর লেখকের নামও আমি জানতাম না। সম্ভবত লোকটা সায়েন্স ফিকশনে নবাগত। কিন্তু বেচারার ক্যারিয়ারের গুড়ে আমি বালি ছড়িয়ে দিলাম। কুবরিকেরও কানে কথাটা এসেছিল, ক্লার্ক অন্যের আইডিয়া ডেভলপে তেমন আগ্রহী নয়। (রামা টুর শেষদিকটা দেখুন, কদশক পরে ক্রেডলের সাথে একটা যোগসূত্র বের করা যায়। তারপর, ফয়সালা হল, আমরা একেবারে নতুন কিছু তুলে আনব।