‘এতেই সিকিউরিটি সন্তুষ্ট হবে।’
‘খুব বেশি তুষ্ট হবার কিছু নেই, সে টি এম এ-১ এর কথাও বলেছে। কথাগুলো কোনো ফাঁকফোকড় ধরে যে বেরিয়ে পড়বে তার নেই ঠিক। এখন আমাদের কিছুই করার নেই। আগে জানতেই হবে, মরার জিনিসটা কী, তারপর জানতে হবে পেছনে চাইনিজ বন্ধুরা আছে কিনা, সবশেষে স্টেটমেন্ট। তার আগে সেটার অস্তিত্ব ঘোষণা করলে আমাদেরই বারোটা বাজার সম্ভাবনা।’
‘ডক্টর মাইকেলস মনে করে সে সঠিক জবাবটা জানে। তোমাকে বলার জন্য নিশ্চয়ই ওর পেট ফেটে যাচ্ছে।’
ফ্লয়েড নামিয়ে রাখে নিজের গ্লাসটা। ‘আর আমার মন ওর কথা শোনার কৌতূহলে ফেটে পড়ছে।’
অধ্যায় ১১. বিশৃঙ্খলা
মিটিং রুমটায় শত মানুষ সহজেই ধরে যাবে। এখানে আছে সর্বাধুনিক অপটিক্যাল আর ইলেক্ট্রনিক ডিসপ্লের ব্যবস্থা। দেখতে একেবারে আদর্শ কনফারেন্স রুমেরই মতো; এর সাথে পোস্টার, পিন পেপার আর নবীস আঁকিয়ের চিত্র দেখা যাচ্ছে দেয়ালজুড়ে। এর মানে জায়গাটা স্থানীয় সংস্কৃতিরও আজ্ঞা। ফ্লয়েড প্রায় ধাক্কা খেয়ে বসেছিল একটা ছবির কালেকশনের সাথে। সেখানেও ফটোগ্রাফারের স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করছে। পৃথিবী থেকে এগুলো আনতেই সবচে কম কষ্ট আর খরচ হয়, বোঝা যায়। সবগুলোর নামই চমৎকার, দয়া করে ঘাস থেকে দূরে থাকুন… দিনের বেলায়ও পার্কিং নিষিদ্ধ… ডিফেন্স ডিফিউমার… সামনে সৈকত… গবাদিপশু পার হওয়ার পথ… নরোম কাঁধ আর পশুকে কোনো খাবার দেবেন না।
এত রুদ্র পরিবেশেও মানুষ তার ফেলে আসা ভুবন নিয়ে স্মৃতি রোমন্থনে মাতে, ঠাট্টা করে, কিন্তু তাদের পরের প্রজন্ম সেই দুনিয়া আর তার এসব ফালতু ব্যাপারকে মোটেও পাত্তা দেবে না।
ফ্লয়েডের আসার অপেক্ষায় বসে আছে জনাপঞ্চাশেক লোক। এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের পেছন পেছন ঢোকার পর সবাই সম্মানের সাথে উঠে দাঁড়ায়।
পরিচিত কয়েকটা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু নড় করেই ফ্লয়েড বলে ওঠে, ‘বিফ্রিংয়ের আগে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।’
অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মঞ্চে উঠে গিয়ে উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করছে এমন সময় ফ্লয়েড সামনের সারিতে বসে পড়ল।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন,’ শুরু করে হ্যাভোরসেন, ‘আমার আবার বলে নেয়া উচিত, এ এক জরুরী মুহূর্ত। নিজেদের মধ্যে ডক্টর হেউড ফ্লয়েডকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আমরা সবাই তাঁর কাজের দ্বারা পরিচিত, আমি ও কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও তাকে চিনি। তিনি এইমাত্র পৃথিবী থেকে একটা স্পেশাল ফ্লাইটে এসেছেন। ব্রিফিংয়ের আগে আগে তাঁর কিছু কথা বলার আছে। ডক্টর ফ্লয়েড।’
ছোট্ট একটু হাসি দিয়ে এগিয়ে গেল ফ্লয়েড, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, এটুকুই শুধু বলতে চাই আমি। প্রেসিডেন্ট আমাকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন যেন আপনাদের অসাধারণ কাজের জন্য শুভেচ্ছাবাণী পৌঁছে দিই। আশা রাখি আমরা কী পেয়েছি তা অতি শীঘ্ন বুঝতে পারব। আমি একটা ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন যে, এখানটায় একটু স্পষ্ট করে কথাগুলো বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, আপনাদের কেউ কেউ কিংবা সবাই চান রহস্য আর গোপনীয়তার চোর পুলিশ খেলাটা তুলে দিতে। আসলে এটা না ভাবলে আপনাদের পক্ষে বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব হতো না।’
চোখ পড়ল ডক্টর মাইকেলসের উপর। নিজের গালে বিশাল একটা ক্ষত-চিহ্ন দিয়ে মাথা উঁচু করে মনোযোগের সাথে ফ্লয়েডের কথা শুনছে বিজ্ঞানী। বোঝাই যায় স্পেসে কোনো দুর্ঘটনা হয়েছিল বেচারার। শক্ত চোখমুখের কারণে আরো বোঝ যায় যে সে ফ্লয়েডের পরের বাক্যে, ‘চোর-পুলিশ খেলা’ কথাটা পছন্দ করেনি।
‘কিন্তু আমার বলা উচিত, যে, এ এক বিশেষ পরিস্থিতি। আমাদের নিজেদেরকে আগে এ নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে। একবার, মাত্র একবার যদি ভুল করে বসি, তাহলে কোনো দ্বিতীয় সুযোগ মিলতে নাও পারে, তাই কষ্ট করে আর একটু ধৈর্য ধরুন। প্রেসিডেন্টেরও একই অভিমত।
‘এটুকুই আমার বলার ছিল। এবার আপনারা রিপোর্ট পেশ করতে পারেন।’
নিজের সিটে ফিরে গেলে প্রশাসক বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, ডক্টর ফ্লয়েড।’ আর তারপরই তার সিনিয়র বিজ্ঞানবিদদের দিকে ঘাড় কাৎ করল। সাথে সাথে উঠে এল মাইকেলস। এবার চারদিকের আলো একটু ফিকে হয়ে আসে। এতে করে শ্ৰোতাকুলের মনোযোগ বক্তার দিকে আকৃষ্ট হবে।
চাঁদের একটা ছবি স্ক্রিনের উপর ভেসে উঠতেই দক্ষিণ-মধ্য চাঁদের এক জ্বালামুখের দিকে সবার দৃষ্টি যায়। তীব্র এক আলো উঠে এসেছে সেখান থেকে। যেন কেউ চাঁদের মুখে একগুচ্ছ ফুল গুঁজে দিয়েছে, আর সেটা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
‘এ হল টাইকো,’ বলছে মাইকেলস, একে বরাবর উপর থেকে দেখলে এত অস্পষ্ট দেখা যায় যতটা পৃথিবী থেকেও দেখা না যায়। কিন্তু এই বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখেন তো আপনারা বুঝতে পারবেন কী করে চাঁদের এই জ্বালামুখটা গোলার্ধ দখল করে রেখেছে।
সে ফ্লয়েডকে এই অতি পরিচিত জিনিসের অতি অপরিচিত চিত্র হজম করার মতো সময় দিয়ে বলতে লাগল, গত বছর থেকে এ এলাকায় আমরা একটা ম্যাগনেটিক সার্ভে করছি। চৌম্বকীয় নিরীক্ষণটা চালানো হয় নিচু স্যাটেলাইট থেকে। সার্ভে শেষ হয় মাত্র গতমাসে আর এ হল তার ফল-এই ম্যাপটাই পুরো সমস্যার সূত্রপাত করে।
আরেক ছবি ভেসে উঠল যেটা শুধু বস্তুর ত্রিমাত্রিকতা দেখায়, আউটলাইন দেখায়। ম্যাপটায় দেখা যাচ্ছে চৌম্বকীয় অবস্থা। বেশিরভাগ স্থানেই রেখাগুলো সমান্তরাল আর সমান। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে সেসব রেখা জট পাকিয়ে যায়। যেন একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে শৈল্পিক বৃত্ত বানানো হয়েছে।