বেস-বিশেষ করে সমগ্র চাঁদে বাসের জন্যই এক বিশাল সুবিধা পাওয়া যায়, কম মধ্যাকর্ষণ। এর ফলে এক অদ্ভুত ভালো থাকার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। এর নিষ্ঠুর দিকও আছে, চাঁদের একজন ইমিগ্র্যান্টের জন্য পৃথিবীতে থাকা অভ্যাস করে নিতে বেশ কয়েক হপ্তা লেগে যায়। চাঁদের বুকে মানবদেহ পুরো নতুন এক নির্ভরশীলতা নিয়ে গড়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো মানুষের শরীরকে ভর আর ওজনের সামঞ্জস্য ঠিক করে নিতে হচ্ছে।
যে লোক পৃথিবীতে একশো আশি পাউন্ড শরীর বয়ে বেড়াত সে চাঁদে ত্রিশ পাউন্ডের ফুরফুরে স্বাস্থ্য নিয়ে চলতে শান্তি পাবে অবশ্যই। যখনি বরাবর চলবে, তখনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। বিপদ দেখা দেয় পাশ ফিরতে নিলেই। হঠাৎই বেচারার আবিষ্কার করতে হবে নিজের একশো আশি পাউন্ডের সবটুকুই বল আকারে ফিরে এসেছে। কারণ এ একটা ব্যাপার সব, স-ব জায়গায় একই, তা, সেটা হোক পৃথিবী, চাঁদ বা স্পেস। একটা ব্যাপারের সাথে অভ্যস্ত হতেই হবে, তাদের ওজনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার তুলনায় সবকিছু ছ’ভাগের একভাগ ধীর হয়ে গেছে। ভরবেগই এর কারণ। এ সমস্যায় পড়তেই হয়। কারো ঘাড়ে গিয়ে পড়া, কারো সাথে রামধাক্কা খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
নিজের জটিল ও একাধিক ওয়ার্কশপ, অফিস, স্টোররুম, কম্পিউটার সেন্টার, জেনারেটর, গ্যারেজ, রান্নাঘর, ল্যাবরেটরি, ফুড প্রসেসিং প্ল্যান্ট নিয়ে ক্ল্যাভিয়াস একাই এক বিশ্ব। আর, সত্যি বলতে গেলে, এই আন্ডারগ্রাউন্ড সাম্রাজ্য গড়তে যে দক্ষতার প্রয়োজন পড়েছে তার অনেকগুলোই অর্জিত হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে।
মিসাইল সাইটে কাজ করা যে কেউ ক্ল্যাভিয়াসে স্বস্তি বোধ করবে। এখানে, এই চাঁদের বুকের ভিতরও কাছাকাছি দৃশ্য দেখা যায়, একই কায়দার যন্ত্রপাতি, একই ছাঁচের জীবন পদ্ধতি, একইভাবে বিরূপ পরিবেশের মোকাবেলা, মাটির নিচের ছোট্ট পরিবেশে বসবাস। পার্থক্য একটাই, এটাই টেনে দেয় যবনিকা, এ স্থান শান্তির জন্যে বানানো। দশ হাজার বছর পর মানুষ যুদ্ধের মতো উত্তেজক অন্য কোনো কাজ পেল।
আফসোস, আজো বাকী বিশ্বের সবগুলো দেশ এ সত্য অনুধাবন করতে পারল না।
.
ল্যান্ডিংয়ের একটু আগেও যেসব দানব-দানব পাহাড় দেখা যাচ্ছিল চারদিক থেকে সেগুলো ভোজবাজির মতো উবে গেছে, তাদের নামগন্ধও নেই। চান্দ্র দিগন্ত খুব দ্রুত আকাশের সাথে মিশে যায় বলে দেখা যাচ্ছে না। স্পেসক্রাফটের চারপাশে একটা সমতল, ধূসর এবং আলোকোজ্জ্বল এলাকা। আকাশটা অবশ্যই পুরোপুরি কালো। শুধু উজ্জ্বল তারা আর কিছু গ্রহ চোখে পড়ে। আকাশের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না, চোখ ঝলসে ওঠে চান্দ্রভূমির আলোয়।
অ্যারেস ওয়ান-বি স্পেসশিপের আশপাশে বেশকিছু কিম্ভুত যানবাহন ভিড় করেছে। কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় আর বাকীগুলো চালায় ছোট্ট প্রেশার কেবিনে বসে থাকা অপারেটর। ভেহিকলগুলোর বেশিরভাগই চলে বেলুন-চাকায়, কারণ এভাবেই উঁচুনিচু ভূমিতে কেবিনের ভারসাম্য রক্ষা হয়। এখানটা সমতল হলেও বাকী চাঁদতে তেমন নয়।
যানগুলোয় সমতল বেশ কিছু প্লেট চারদিকে বৃত্তাকারে থাকে। প্রতিটি আলাদাভাবে বসানো, নিখুঁতভাবে সাজানো। আর আছে ফ্লেক্স হুইল, এতে ক্যাটারপিলার ট্রাকের প্রায়
সব গুণই ধরা দেয়, তবে আরেকটু উন্নত হয়ে। আসলে ক্যাটারপিলার থেকেই এসব– ধারণার উদ্ভব। যেদিক দিয়েই যাক না কেন, বন্ধুরতার সাথে মানিয়ে নিতে পারে পুরোপুরি। যানগুলোর কিছু অংশ খোয়া গেলেও চলতে পারবে।
বেঁটে হাতির মতো একটা বাস ইয়া বড় শুড় নিয়ে চান্দ্রযানের গায় সেঁটে যাচ্ছে, এ ঔড়ই শিপ থেকে বাসে ওঠার পথ। কয়েক সেকেন্ড পরেই বাইরে ধাতব শব্দ আর বাতাসের হিসহিসানি শোনা গেল। বাতাসের সংযোগ হবার সাথে-সাথেই এয়ার প্রেশার ঠিক হয়ে গেছে। এয়ারলকের ইনার ডোর খুলে যাবার পর স্বাগত জানানোর মেজবানরা প্রবেশ করল সম্মানিত মেহমানকে বেসে নিয়ে যেতে।
এগিয়ে ছিল র্যালফ হ্যাভোরসেন, সে সাউদার্ন প্রভিন্সের প্রশাসক-এর মানে হল, সে শুধু বেসের শাসনকর্তা নয়, বরং দক্ষিণ চাঁদের সব অভিযানের নিয়ন্তা। সাথে চিফ সায়েন্টিস্ট ডক্টর রয় মাইকেলস। এই ছোট্ট অবয়বের জিওফিজিসিস্টকে ফ্লয়েড আগের চন্দ্রভ্রমণগুলোর সময় থেকেই চিনত। আর আছে আধ ডজন সিনিয়র বিজ্ঞানী, প্রশাসক। তাকে সম্মানের সাথে তারা রিসিভ করল। কোনো এক গোপন গুরুভার যে তাদের উপর থেকে নেমে গেল ফ্লয়েড আসার পর সেটা তাদের দেখেই বোঝা যায়। নিজেদের দুঃখ কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে তারা যে উন্মুখ ছিল এতটা অন্তত স্পষ্ট।
‘আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত, ডক্টর ফ্লয়েড,’ অফিসিয়াল মনোভাব নিয়ে বলল হ্যাভোরসেন, ‘ট্রিপটা ভালো কেটেছে তো?’
‘চমৎকার,’ জবাবে ফ্লয়েড জানায়, এরচে ভাল হতেই পারে না। কুরাতো সারাক্ষণ যত্নআত্তি করেই কাটাল।
এরপর সেই পুরনো বিরক্তিধরানো শুভেচ্ছাবাণী বাকীদের সাথেও কপচিয়ে নিয়ে চড়তে হল বাসে। না বলা কোনো চুক্তির বলেই যেন তারা কেউ তার হঠাৎ এই ভিজিটের ব্যাপারে কোনো কথাই বলল না। হাজারখানেক ফুট পেরিয়ে বাস এলো একটা বড় লেখার সামনে