পাইলট সানড্রাই সুইচ চেপে ধরার পরই সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে, সাথে সাথেই কলব্যাক পাঠায় দক্ষ নাবিক, ‘সব ম্যানুয়াল পরীক্ষণ শেষ। হাইড্রোলিক প্রেশার, শক প্যাড ইনফ্লেশন আর ল্যান্ডিং গিয়ার লক ঠিক আছে পুরোপুরি।’
‘কনফার্মড।’ বলল চাঁদ। বাকী কথা হারিয়ে গেল যেন। হ্যাঁ, আরো শত কথা বাকী, সেটা চলছে যন্ত্রপাতির সাথে। যন্ত্রগুলো ধীর মালিকদের চিন্তার চেয়ে সহস্রগুণ দ্রুতিতে বাইনারি সংকেত পাঠিয়ে চলছে অবিরত।
এর মাঝেই বেশকিছু মাউন্টেন পিক চান্দ্রযানের মাথার উপর থেকে উঁকি মারা শুরু করেছে। ভূমি আর মাত্র কয়েক হাজার ফুট নিচে। কয়েকটা নিচু বিল্ডিং আর কিম্ভুতকিমাকার যানবাহনের ভিড় ঠেলে দেখা দিচ্ছে বিশাল নক্ষত্রের মতো বিকন লাইটেরআলো। শেষ পর্যায়ে জেটগুলো যেন কোনো জটিল আর সূক্ষ্ম সুর তোলার চেষ্টায় রত। এমন সুরেই সেগুলো দিয়ে বেরুচ্ছে জ্বালানী। থ্রাস্টের সাথে শেষ মুহূর্তের কাজ চালানোর জন্যই এ কাজ।
এলোমেলোভাবে ধূলির এক ঝড় আশপাশটাকে ভরিয়ে তুলতে চাচ্ছে। জেটগুলো অন্তিম এক গর্জন দিয়ে শাটলকে আলতো হাতে চাঁদের বুকে নামিয়ে দিল। এত হালকাভাবে চান্দ্রযান নামল যেভাবে কোনো রাবারের নৌকা ছোট্ট ঢেউয়ের মুখে আন্দোলিত হয়। কয়েক মিনিট আগে হলেও এখনকার এ নিরবতাকে ফ্লয়েড মেনে নিতে পারত না, কিন্তু তার সাথে এবার হাল্কা অস্বস্তিকর গ্র্যাভিটিও মেনে নিতে হচ্ছে।
নিতান্তই আটপৌরে রুটিন ফ্লাইটের পর ডক্টর ফ্লয়েড পদার্পণ করে চির আকাক্ষিত চাঁদের বুকে। একেবারে নিরাপদে একদিনের একটু বেশি সময় নিয়ে শেষ করেছে সেই বুক কাঁপানো যাত্রা-যেটার আশায় সহস্র কোটি মানুষ দু-হাজার বছর ধরে ব্যাকুল ছিল। আসলেই কি মাত্র দু-হাজার বছর?
অধ্যায় ১০. ক্ল্যাভিয়াস বেস
ব্যাসে দেড়শো মাইল, ক্ল্যাভিয়াস, চাঁদের দেখা যাওয়া অর্ধাংশের দ্বিতীয় বড় জ্বালামুখ। অবস্থান দক্ষিণ চাঁদের উচ্চভূমিতে। খুবই পুরনো, শত বছর ধরে লাভার উদ্গীরণ হয়েছে, হাজার হাজার বছর ধরে এর শুকনো বুকে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে মহাকাশের আগন্তুকেরা। উল্কা, পাথর, কণা।
কিন্তু শিলাসৃষ্টির শেষ যুগ থেকেই এটা শান্ত। আজো অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের ছোট্ট গ্রহাণুরা আঘাত হানে ভিতরের দিকের গ্রহগুলোয়, কিন্তু চাঁদের এ অংশ গত পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে একদম।
আর আজ, এর ভিতরে বাইরে কী অদ্ভুত আলোড়ন! চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম স্থায়ী ফোস্কা পড়েছে ঠিক এখানটাতেই। বিশেষ প্রয়োজনে ক্ল্যাভিয়াস বেস স্বয়ং একটি পরিপূর্ণ দুনিয়া হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় পাথর থেকেই জীবনধারণের সবকিছু গড়ে ওঠে। শুধু দরকার ভাঙা, তাপ দেয়া, রাসায়নিক বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণ। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস থাকলে আর কী চাই! উপরি পাওনা হিসেবে জুটবে বাকী মৌলের বেশিরভাগ, শুধু জানা চাই কোথায় খুঁজতে হবে।
বেসটা এক ক্লোজড সিস্টেম; অভ্যন্তরীণ পরিবেশ-ব্যবস্থা। বসুন্ধরার এক ছোট্ট কর্মচঞ্চল মডেল যেন। এখানে জীবনের সবকিছুকেই রিসাইক্লিং করে নেয়া হয়। কোনো কিছুই ফেলা হয় না, সবকিছু থেকেই পুনরুৎপাদন। তারপর আবার, বারবার। বায়ুমণ্ডলটা পরিষ্কার করা হয় এক বিশাল ‘হটহাউস’-এ। এ এক বিরাট গোলাকার ঘর; অবস্থান চান্দ্র ভূমির নিচে। রাতে আশীর্বাদধন্য কৃত্রিম আলোকমালা আর দিনে ছেকে শুদ্ধ করা সূর্যালোক একরের পর একর এলাকাজুড়ে খাটো আর ঝাকড়া গাছের জীবন দিয়ে চলে। পরিবেশটা একদম উষ্ণ। সেগুলোর আছে অন্যরকম ক্ষমতা, আরো বেশি অক্সিজেন দেয়, পার্শ্ব ফলন হিসেবে খাদ্যতো আছেই।
বেশি খাদ্যোৎপাদনের জন্য কেমিক্যাল প্রসেসিং সিস্টেম আর অ্যালগি[২০] কালচারের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা হয়। বেসের চারদিকে স্বচ্ছ প্লাস্টিক : টিউবগুলোর বিস্তৃত এলাকার ভিতরে গজিয়ে ওঠা অজস্র আগাছা একেবারে হেলায় ফেলে রাখা হচ্ছে, কারণ খাদ্য সংকট নেই। প্রয়োজন পড়লেই একজন বায়োকেমিস্ট এ থেকে এমন চপ আর সুস্বাদু সজি গড়ে তুলতে পারে যার সাথে আসল খাবারের পার্থক্য নিতান্ত অভিজ্ঞজন ছাড়া কেউ আদৌ বুঝবে না।
বেসের এগারোশ পুরুষ আর ছ’শ মহিলার সবাই সর্বোচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী নয়তো টেকনিশিয়ান। পৃথিবী ছাড়ার আগে তাদেরকে হাজার সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা হয়েছে। আজ লুনার বেস বলতে গেলে একদম সহজ পরিশ্রমের স্থান। আজ আর প্রাথমিক সময়ের মতো অসুবিধা, দুর্ঘটনা কিংবা অঘটন ঘটে না। কিন্তু ভয় রয়েই গেছে, সামান্যতম ক্ল্যাস্ট্রোফোবিয়ায় ভোগা মানুষও এখানে কাজে আসার অনুমতি পায় না। একেবারে নিরেট পাথর আর লাভা কেটে কেটে চাঁদের বুকে ঘাটি পাতা নিতান্তই খরুচে ব্যাপার ছিল, সময়ও লেগেছে খুব বেশি। তাই এখানে একটা ভালো ‘ওয়ান-ম্যান’ রুম মাত্র ছ’ফুট চওড়া, দশফুট লম্বা আর উচ্চতায় আট।
প্রতিটিই আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো, দেখতে যে কোনো ভালো মোটেল স্যুটের মতোই। কনভার্টেবল সোফা, টিভি, ছোট্ট হাই-ফাই সেট আর ভিশন ফোন এর অংশ। একটু কৌশল করে একেবারে চোখের সামনে সেঁটে থাকা দেয়ালটাও কাজে লাগিয়ে ফেলা হয়েছে, পার্থিব বিশাল আটটি ছবি চারদেয়ালে ফুটিয়ে তোলা যায়। এত বিলাস খুবই প্রয়োজন বেসের জন্য, কিন্তু তারপরও পৃথিবীতে ব্যাখ্যা পাঠাতে হয় প্রতিনিয়ত। ক্ল্যাভিয়াসের প্রত্যেক নারী-পুরুষের পেছনেই ট্রেনিং, যাতায়াত আর বাসার জন্য শতসহস্র ডলার খরচ হয়; তাই তাদের মনের শান্তি আর ভারসাম্য রক্ষার পেছনে একটু ব্যয় করাই যায়। এ শিল্পের খাতিরে শিল্প নয়, সুস্থতার খাতিরে শিল্প।