একমাত্র কমবয়েসী মিষ্টি স্টুয়ার্ডেসকেই তার উপস্থিতিতে একদম স্বচ্ছন্দ মনে হয়। হঠাৎ ফ্লয়েড আবিষ্কার করে বসে, মেয়েটা এসেছে বালি[১৯] থেকে। বোঝা যায়, সে আজো বহন করে চলেছে সেই পরিবেশের মধুর রহস্যময়তা। আজো বিশাল এ দ্বীপ নষ্ট হয়ে যায়নি, হারায়নি তার দারুণ সৌন্দর্য। তার অবাক লাগে, এই পুরো ট্রিপের মধ্যে সবচে ভালো লেগেছে জিরো গ্র্যাভিটির কিছু অনিন্দ্যসুন্দর ব্যালে নৃতের মহড়া। মেয়েটা নিশ্চয়ই নাচছে না, কিন্তু দেখে তেমন মনে হয়। পেছনে নীলচে পৃথিবীর যবনিকা।
নিভে গেছে কেবিন লাইট। ঘুমানোর সময় ইলাস্টিক স্ট্র্যাপে নিজের হাত-পা আটকে নেয় ফ্লয়েড। ঘুমের মধ্যে এদিকসেদিক ভাসতে হবে না আর। একটু বেখাপ্পা দেখালেও এটাই রীতি। ফ্লয়েডের কাউচটা পৃথিবীর যে কোনো ম্যাট্রেসের চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক।
নিজের ভিতর ডুবে যাবার পর অর্ধসচেতনভাবে জেগে উঠে সে বেশ বিপাকে পড়ে যায়। আশপাশটা দেখে চিনতে পারেনি প্রথমে। একপলের জন্য মনে হয় সে শুয়ে আছে কোনো টিমটিমে চাইনিজ লণ্ঠনের ভিতরে। আশপাশের কিউবিকল থেকে আসা ক্ষীণ আলোকমালায় এমনটা মনে হতেই পারে। এরপর নিজেকে শুনিয়ে বলে চলে, ‘ঘুমাও, ছেলে। এ এক সাধারণ মুন শাটল।’
জেগে উঠে সে আধ আকাশের অধীশ্বর চাঁদকে দেখতে পায়। ব্রেকিং প্রকৌশল শুরু হবে এখুনি। প্যাসেঞ্জার সেকশনের বাঁকানো দেয়ালে বিশাল জানালার এক বৃত্তচাপ আছে। সেটা দিয়ে এবার আর এগুতে থাকা গ্লোবের দেখা পাওয়া যাবে না। দেখা যাবে আকাশ। তাতে কী, রিয়ারভিউ টিভিতে ভালোভাবেই চূড়ান্ত পর্যায় দেখা যায়। টিভি স্ক্রিনটা কন্ট্রোল কেবিনে, অগত্যা তার সেদিকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আসতে থাকা চান্দ্র পাহাড়গুলো পৃথিবীর পাহাড় থেকে অনেক অনেক ব্যতিক্রমী। তাদের নেই পার্থিব পর্বতের তুষারশুভ্র টুপি, নেই সবুজের ছড়াছড়ি। উদ্ভিদজগতের অনিন্দ্যসুন্দর আটসাট পোশাক নেই তাদের, নেই মেঘরূপী সদাচলন্ত কিরিটী। মেঘ-মুকুট ছাড়া কোনো পাহাড়কে কি সম্রাট মনে হয়?
তাতে কী? তাদের অবাক করা আলো আঁধারের সৌন্দর্যটাতো একান্তই নিজস্ব। দুনিয়াব্যাপী সৌন্দর্যের সংজ্ঞাগুলো এখানে অসহায়। এ ভুবন গড়ে উঠেছে আরেক শক্তিতে। সময়ের অনন্ততার উপর এর ভিত, কোনো অর্বাচীন একে বুঝে উঠতে পারবে না এক লহমায়। প্রতিনিয়ত নতুন রূপ নেয়া শ্যামল পৃথিবী তার ভেসে চলা বরফ যুগ, তার সদাচঞ্চল সাগর আর সূর্যোদয়ের আগের ধোঁয়াশার মতো পাহাড় নিয়ে এই অসীমের স্পর্শ পেতে পারবে না। এখানে একটাই যুগ, অসীম, অস্পৃশ্য, অনন্ত। একে মৃত্যু বলা যায় না, কারণ শশী কখনোই জীবিত ছিল না। অন্তত আজ পর্যন্ত এটাই সত্যি।
দিন আর রাতের স্থির রেখার ভিতর নেমে আসছে শিপটা। নিচে আলো আঁধারীর মিশেল, অতি ধীর চান্দ্র সূর্যোদয়ের প্রথম কিরণের স্পর্শ পায় নিঃসঙ্গ চূড়াগুলো। সবচে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়েও এখানে ল্যান্ড করাটা ভয়ংকর হওয়ার কথা। ধীরে সরে গেল এলাকাটা, এগিয়ে আসছে রাতের পাশ।
একেবারে ক্ষীণতম আলোর সাথে চোখ সয়ে এলে ফ্লয়েড দেখতে পায় ফ্লাইটের ল্যান্ডিং এলাকা একেবারে আলোকহীন নয়। এক ভৌতিক বিচ্ছুরণে আলোকিত হয়ে আছে আশপাশটা। চূড়া, পাথর আর সমতল দেখা যাচ্ছিল একেবারে স্পষ্ট। চাঁদের আকাশেও আছে এক দানবাকার চাঁদ। পৃথিবীর আলো এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে চতুর্দিক।
পাইলট প্যানেলের রাডার স্ক্রিনে আলো খেলে খেলে যায়। কম্পিউটার ডিসপ্লেতে সংখ্যা ওঠে অনেক, হারিয়েও যায় আবার। প্রতি পলে চাঁদের সাথে দূরত্ব মেপে চলছে যন্ত্রপাতি। প্রথম ওজন ফিরে আসার সময় চাঁদের ভূমি হাজার কিলোমিটার নিচে ছিল। আলতো একটু ঝাঁকি এল, তারপর নিচের দিকে সম্মোহন। যুগযুগ ধরে চেষ্টা করে যেন চাঁদটা পুরো আকাশ দখল করে নিল। কবেই ডুবে গেছে সূর্য, শেষে এক দানো শৃঙ্গ অধিকার করে নেয় বাকী আকাশটা।
শাটল যাচ্ছিল কেন্দ্রীয় চুড়ার দিকে। একেবারে অকস্মাৎ ফ্লয়েড আবিষ্কার করে বসে, সবচে কাছের শৃঙ্গটা থেকে আলো আসছে নিয়মিত ছন্দে। পৃথিবীর হিসাবে এ এক এয়ারপোর্ট বীকন। দম আটকানো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ফ্লয়েড, মানুষ যে চাঁদে তার সর্বজয়ী পা রেখেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ এ আলো।
এবার উঁচুভূমি এত বেশি এগিয়ে এসেছে যে দেখে মনে হতে পারে এর গিরিজ্বালামুখটা হাঁ করা; ছোটগুলো যেন সাজপোশাক, তীক্ষ্ণ পাথুরে অগ্রভাগগুলো উপরের দিকে চেয়ে আছে ব্যাকুলভাবে। এরা সবাই যেন নিজেদের আসল রূপ ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী। কোনো কোনোটা পুরো এক নগরীকে বুকে ধরার মতো মাইলের পর মাইল প্রান্তর জুড়ে আছে।
নক্ষত্রালোকে আলোকিত আকাশ থেকে পিছলে নামছে মুন শাটল। নিজের কাজের উপর এ যান পুরো কর্তৃত্ব রেখেছে। কেবিনের ভিতর ছুটতে থাকা ইলেক্ট্রনিক বীপিং আর জেটগুলোর তর্জন-গর্জন ছাপিয়ে কোত্থেকে যেন একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ফ্লয়েড শুনতে পায় কণ্ঠের গুঞ্জন।
‘ক্ল্যাভিয়াস কন্ট্রোল থেকে স্পেশাল ফোর্টিনকে বলছি, এগিয়ে আসছেন দারুণভাবে। হাইড্রোলিক প্রেশার, শক প্যাড ইনফ্লেশন আর ল্যান্ডিং গিয়ার লকের উপর হাতেনাতে চেকিংটা সেরে ফেলুন প্লিজ।’