ওয়াশরুমের ডিজাইনের পেছনে পুরো একটা প্রজন্মের ‘মহান’ স্বেচ্ছাশ্রম ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কেউ এ মহত্ত্ব নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না। আজ এ রুমটা কমবেশি ‘পরিণত’ হিসেবে বিবেচিত। মুক্ত পতন শুরুর পরপরই এর খোঁজখবর নেয় ফ্লয়েড। নিজেকে আবিষ্কার করে একটা সাধারণ বিমান-ওয়াশরুমের মতো দেখতে একটা কিউবিকলে। শুধু একটা জিনিসই নিষ্ঠুরভাবে জুলজুল করছে চোখের উপর। লাল আলোতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘সবচে গুরুত্বপূর্ণ! আপনার নিজের আরামের জন্য এই ইট্রাকশনগুলো পড়ে নিন প্লিজ!’
ফ্লয়েড বসে নেয় (ওজনহীনতায়ও মানুষ ভুলে বসে পরে) তারপর পড়ে নেয় কয়েকবার। আগের ট্রিপের পর কোনো পরিবর্তন আসেনি বুঝতে পেরেই চেপে দেয় স্টার্ট বাটন।
হাতের কাছাকাছি একটা ইলেক্ট্রিক মোটর বনবনিয়ে ঘুরছে। ফ্লয়েড নিজেকে আবিষ্কার করে ঘুরন্ত অবস্থায়। নোটিশের উপদেশ মতো সে চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ। মিনিটখানেক পরেই একটা বেল বেজে উঠলে চারপাশে তাকায় সে।
এবার আলো নিখাদ গোলাপি-সাদায় বদলে গেছে। তারচেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার-সে গ্র্যাভিটি ফিরে পেয়েছে। একদম মৃদু কাপনেই শুধু বোঝা যায় যে অভিকর্ষটা কৃত্রিম। পুরো টয়লেট কম্পার্টমেন্ট করোসেলের মতো ঘুরছে। এক টুকরো সাবান তুলে নেয় ফ্লয়েড, তারপর ধীরে এটার পড়ে যাওয়া দেখতে পায়। সে নিশ্চিত হয়ে নিল যে সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স সাধারণ গ্র্যাভিটির অন্তত চারভাগের একভাগ হয়েছে। এই যথেষ্ট। বোঝা যাচ্ছে অন্তত যেখানে ঠিকমতো চলাটা জরুরী সেখানে সব চলছে ঠিকঠাক।
সে ‘স্টপ ফর এক্সিট’ বাটনটা চেপে ধরেই আবার বন্ধ করে চোখ। ঘুর্ণন কমার সাথে সাথে ওজন আবার পালিয়ে যাচ্ছে। বেলটা দুবার বেজে উঠতেই লাল ওয়ার্নিং বাতি জ্বলে ওঠে। দরজাটা ঠিক জায়গামতো লক হয়ে যায়। এবার ঠিকমতো ভেসে বেরুনো যাবে। কেবিনে ঢুকেই সে নিজেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আটকে নেয় কার্পেটের সাথে। বহুকাল আগেই সে ওজনহীনতার মহত্ত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। আজ আর অভিকর্ষহীনতা মজার কোনো অভিজ্ঞতা নয়, বরং তার কাছে ভেলক্রো চপ্পল এক প্রকার আশীর্বাদ।
সময় কাটানোর অনেক ব্যবস্থাই আছে। এমনকি বসে বসে পড়লেও সময় কেটে যেতে পারে। অফিসিয়াল রিপোর্ট আর মেমোরেন্ডার দঙ্গল দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে পড়লেই সে নিজের ফুলস্কেপ কাগজ গড়নের নিউজপ্যাডটাকে শিপের ইনফরমেশন সার্কিটের সাথে যুক্ত করে নেয়। চোখ বুলিয়ে নেয় পৃথিবীর সর্বশেষ খবরগুলোয়। একের পর এক পৃথিবীর তাবৎ বড় পত্রিকা তুলে আনে। গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রিক নিউজপেপারগুলোর কোডও আর মুখস্ত। প্যাডের পেছন থেকে দেখে নিতে হয় না। ডিসপ্লে ইউনিটের শর্ট টার্ম মেমোরিতে সুইচ করেই প্রথম পাতাটা পাওয়া যায়। সাথে সাথেই কৌতূহলোদ্দীপক হেডলাইনগুলো নোট করে নিচ্ছে। প্রতিটির আছে দু’ডিজিটের ভিন্ন রেফারেন্স নাম্বার। ডিজিট চাপলেই পোস্টেজ-স্ট্যাম্প আকারের ছোট্ট চতুষ্কোণ খবরটা প্রসারিত হতে হতে প্রায় পুরো নিউজপ্যাড ভরে তোলে, যাতে আয়েশ করে পড়া যায়। পড়া শেষ হতেই চলে যাওয়া যায় পুরো পাতায়, তারপর বাকী থাকে প্রয়োজনমাফিক অন্য কোনো বিষয় বেছে নেয়া।
মাঝে মধ্যেই ফ্লয়েড বেশ ধাঁধায় পড়ে যায়, কে জানে-নিউজপ্যাড আর এর পেছনের টেকনোলজিই মানব সভ্যতার যোগাযোগের শেষ ও পরিপূর্ণ পরিণতি কিনা! এইতো, সে বেরিয়ে পড়েছে অসীম স্পেসের বুকে; মৃত্তিকা থেকে সরে যাচ্ছে প্রতি ঘন্টায় কত সহস্র মাইল দূরে-এখনো চাওয়ামাত্র যে কোনো খবরের কাগজের হেডলাইন দেখতে পায় কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে। (‘খবরের কাগজ’ শব্দটা নিশ্চয়ই আধুনিক ইলেক্ট্রনিক যুগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া সিন্দাবাদের ভূত! এ নামের অস্তিত্ব শুধু অতীতেই ছিল, ব্যবহার বর্তমানে।) প্রতি ঘন্টায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য নবায়ন করা হয়। কেউ যদি শুধু ইংরেজি খবরগুলোই পড়তে থাকে, তবু নিউজ স্যাটেলাইটগুলো থেকে আসতে থাকা চির পরিবর্তনশীল সংবাদ প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে একটা পূর্ণ জীবন পার করে দিতে পারে সহজেই।
কী করে যে পুরো সিস্টেমটা অটোম্যাটিক আপগ্রেড হয় তা ভেবেই কুল কিনারা পায় না সে। কিন্তু আজ হোক আর কাল, ফ্লয়েড জানে, এটাও ভেসে যাবে প্রযুক্তির বাধাহীন তোড়ে। এমন অকল্পনীয় কিছু সিন্দাবাদের ভূতের দায়িত্ব নেবে, যা ভাবতেও বিষম খেতে হয়। সেদিনও হয়তো এর নাম থাকবে ‘নিউজপেপার’! কক্সটন বা গুটেনবার্গ কোনোদিন কি নিউজপ্যাড স্বপ্নেও দেখেছিলেন?
আরো একটা ব্যাপার যেন ধরা দেয় ঐ ছোট্ট নিউজগুলোয়। দিনকে দিন যোগাযোগ মাধ্যম যতই চমৎকার হচ্ছে, ততই যেন সাধারণ, সস্তা আর হতাশাজনক হয়ে পড়ছে এর উপাদানগুলো। অ্যাক্সিডেন্ট, অপরাধ, প্রাকৃতিক আর মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, যুদ্ধের হুমকি-ধামকি, নীরস সম্পাদকীয়-এসবই যেন ইথারের মধ্য দিয়ে পৃথিবীময় ছড়ানো লাখো শব্দের মূল লক্ষ্য। অবশ্য আজো ফ্লয়েড নিশ্চিত হতে পারেনি ব্যাপারটা খুব খারাপ হল কিনা। ইউটোপিয়ার সংবাদপত্রগুলো অসম্ভব মলিন আর বিরক্তিকর দেখাবে নিশ্চয়ই।
কিছুক্ষণ পরপরই কেবিন ক্রু আর ক্যাপ্টেন কেবিনে একটু ঢু মেরে যায়। কথাও হয় দু-চারটি। তারা অতি আগ্রহের সাথে তাদের বিশিষ্ট যাত্রীর সাথে কথা বলে। তবে মজার ব্যাপার হল, কথা বলায় শিষ্টতা রক্ষার চেয়ে তাদের গোপন মিশনের ব্যাপারে ব্যাকুলতাই বেশি ধরা পড়ছে। তবে বাঁচোয়া, তারা যথেষ্ট ভদ্র, একটা কথা তো দূরে থাক, এ বিষয়ে এক বিন্দু ইশারাও করে না।