‘কিন্তু রোগটা কী? এর লক্ষণটক্ষণ? অপার্থিব নয়তো? আমাদের মেডিক্যাল সার্ভিসের একবিন্দু দরকার থাকলেও বলতে পার।’
‘আই এ্যাম স্যরি, দিমিত্রি-এ মুহূর্তে টু শব্দটাও করতে পারব না আমরা। অফারের জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু নিজেরাই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারব।’
‘হুমম্’ একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে বলল ময়শেভিচ, ‘আমার চোখে একদম বেমানান ঠেকে যে তুমি, একজন অ্যাস্ট্রোনমার হয়েও চাঁদে চলে যাচ্ছ একটা মহামারীর দেখভাল করতে।’
‘আমি শুধুই একজন প্রাক্তন জ্যোতির্বিদ, বা মহাকাশবিজ্ঞানী, যাই বলনা কেন। অনেক বছর ধরে কোনো রিসার্চ করি না। এখন শুধুই একজন সায়েন্টিফিক এক্সপার্ট, তার মানে হচ্ছে, আমি কোনোকিছুরই পুরোপুরি সবটুকু জানি না।’
‘তার মানে, তুমি হয়তো টি এম এ-১ নিয়েও তেমন কিছু জান না, জান কী?’
মনে হচ্ছে যেন মিলার নিজের ড্রিঙ্কে এক্কেবারে চুর হয়ে গেছে, জগতের কোনো কথাতেই তার কান নেই। কিন্তু ফ্লয়েড নিতান্তই কঠিন চিজ। সে নিজের পুরনো দোস্তের দিকে চোখে চোখে তাকায়, বরফশীতল নির্লিপ্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘টি এম এ-১? কী অদ্ভুত নামরে বাবা! কোথায় শুনলে এসব?
‘নেভার মাইন্ড।’ জবাব ছেড়ে রাশিয়ান, ‘আমাকে বোকা বানাতে পারবে না তুমি। কিন্তু তোমরা যদি এমন কিছু নিয়ে মেতে থাক যা আর সামলে উঠতে পারছ না, আশা করি সেটা সামলেসুমলে উঠতে গিয়ে এত দেরি করে বসবে না যাতে হল্লা করে মরতে হয় ‘হেল্প! হেল্প!’ বলে।’
মিলার অর্থপূর্ণভাবে নিজের ঘড়ির দিকে তাকায়।
‘আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছাড়ছে ডক্টর ফ্লয়েড। মনে হয় এখনি যাওয়া ভালো।’
যদিও সে জানে হাতে জলজ্যান্ত বিশটা মিনিট পড়ে আছে, তবু তোণ্ডতি করে উঠে পড়ে। এত বেশি ব্যস্ত দেখায় যে গ্র্যাভিটির ছ’ভাগের একভাগের কথাটা মনেই পড়ে না। উড়ে যাওয়া ঠেকাতে সময়মতো টেবিলটা খপ করে ধরে নিয়ে নিজেকে সামলায়।
‘তোমার সাথে দেখা হওয়ায় দারুণ লাগল, দিমিত্রি।’ কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, ‘আশা করি পৃথিবীতে দারুণ এক ভ্রমণ শেষে ফিরবে-ফিরে এলেই একটা কল দেব তোমাকে।’
লাউঞ্জ ছেড়ে ইউ এস ট্রানজিট ব্যারিয়ারে গিয়েই ফ্লয়েড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ‘ফুহ-কানের পাশ দিয়ে গুলি গেল। আমাকে সময়মতো উদ্ধার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
‘জানেন, ডক্টর,’ সিকিউরিটি অফিসার হালকা লয়ে বলে, ‘আশা করি তার কথাটা ঠিক না।’
‘কোন্ কথাটা?’
‘সামলে উঠতে পারি না এমন কিছুতে হাত দেয়া না কী যেন বললেন তিনি…’
‘ঠিক’ বলে ওঠে ফ্লয়েড, এই ব্যাপারটা দেখতেই আমি যাচ্ছি।’
পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে এ্যারেস ওয়ান বি লুনার ক্যারিয়ার স্টেশন থেকে ভেসে ওঠে। পৃথিবী থেকে টেক অফের মতো ঝক্কি ঝামেলার কোনোটাই এখানে নেই-শুধু লো ব্রাস্টের একটা প্রায় শ্রবণসীমার নিচের দূরাগত শব্দ। লো থ্রাস্ট প্লাজমা জেটগুলো মহাকাশে তাদের তড়িত্বন্যা বইয়ে দিলেই এমন শব্দ ওঠে। হালকা ধাক্কা চলে মিনিট পনের ধরে, তারপরের মৃদু গতিবৃদ্ধি কাউকেই নিজের ভেসে বেড়ানো থেকে বিরত করেনি। এবার আর যানটা বাঁধা পড়ে নেই পৃথিবীর মায়াজালে। এটা আর স্পেস স্টেশন বা চাঁদের মতো কোনো উপগ্রহ নয়। এ্যারেস ওয়ান বি’র উপর পার্থিব কোনো বল কাজ করছে না বলেই এখন এ এক মুক্ত গ্রহ।
ফ্লয়েড একা যে কেবিন জুড়ে বসেছে সেটা আসলে ত্রিশজনের জন্য বানানো। চারদিকের খালি খালি সিট দেখতে অদ্ভুত লাগে, ভর করে একাকিত্ব। বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার হল, ত্রিশজন অতি দামী, অতি সম্মানিত এবং কিছু ক্ষেত্রে অতি খরুচে যাত্রীর জন্য যথেষ্ট যে স্টুয়ার্ড আর স্টুয়ার্ডেস, তাদের সবার কাজের এবং মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সে। পাইলট, কো পাইলট আর দুই ইঞ্জিনিয়ারের কথা বলতে হয় না। বড়ই সন্দেহ তার, ইতিহাসে আর কোনো মানবসন্তান এত বেশি এক্সক্লসিভ সার্ভিস পেয়েছে কিনা; আর ভবিষ্যতে কারো পাওয়ার আশা তো আরো কষ্টকল্পনা। তার অকস্মাৎ মনে পড়ে যায় কোনো এক অনুল্লেখ্য ধর্মগুরুর কথা, এবার যখন পোপত্ব পেয়েই গেলাম, চলো, উপভোগ করি ব্যাপারটা। যাক, সেও এ ট্রিপ আর ওজনহীনতার চরম আনন্দ উপভোগ করতে পারে। ওজনহীনতা মুহূর্তের জন্যে হলেও তার সচেতনতাকে ঢেকে ফেলে। কে যেন একবার বলেছিল, আপনি স্পেসে আতঙ্কে অস্থির হতে পারেন, কিন্তু একবিন্দু দুঃখও পেতে পারেন না। একদম খাঁটি কথা।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে স্টুয়ার্ড বেচারা ট্রিপের পুরো পঁচিশ ঘন্টা জুড়েই তাকে খাইয়ে যাবার পণ করেছে। ফ্লয়েড ক্রমাগত ফিরিয়ে দিচ্ছে একের পর এক খাবার। এখন আর জিরো গ্র্যাভিটিতে খাওয়াদাওয়াটা কোনো সমস্যাই নয়, আঁধারে হারিয়ে যাওয়া সাবেক অ্যাস্ট্রোনটদের কথা অবশ্য পুরো বিপরীত। সে একটা সাদামাটা টেবিলের সামনে বসেছে, সেটায় সেঁটে দেয়া হয় খাবারের প্লেটগুলো-যেন সে বসে রয়েছে উত্তাল সাগরের টালমাটাল কোনো জাহাজের ডেকে। প্রতিটা জিনিসই সেঁটে থাকে, যাতে কেবিনজুড়ে বিশ্রী ওড়াউড়ি ঠেকানো যায়। যেমন, একটা চপ আটকে থাকে আঠালো সসের সাথে, বা কোনো সালাদের প্রিপারেশনের সাথে থাকবে থকথকে কোনো না কোনো তরল। আসলে একটু সতর্ক থাকলে সবই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিষিদ্ধ খাবারের মধ্যে আছে গরম গরম স্যুপ আর একদম ভঙ্গুর পেস্ট্রি। ড্রিঙ্কের ব্যাপারে পরিস্থিতি একটু ভিন্ন, সব তরলই খেতে হয় প্লাস্টিকের স্কুইজ বোতলে করে।