‘মিস ফ্লেমিং- ফ্লয়েড বলছি। স্যরি, তাড়াহুড়ো করে পৃথিবী ছাড়তে হল। আমার অফিসে কল করে গাড়িটা ডালাস এয়ারপোর্ট থেকে যোগাড় করে নিতে বলবে। চাবিটা সিনিয়র ফ্লাইট কন্ট্রোল অফিসার মিস্টার বেইলির কাছে রেখে এসেছি। এরপরই একটু কষ্ট করে চেভি চেস কান্ট্রি ক্লাবে কল করে সেক্রেটারির কাছে একটা খবর পাঠাবে। আগামী হপ্তায় টেনিস টুর্নামেন্টে কিছুতেই অংশ নিতে পারছি না। আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিও-মনে হয় আমাকে ধরেই হিসাব করবে ওরা। তারপর ডাউন টাউন ইলেক্ট্রনিক্সে ফোন করে বলবে তারা যদি আমার স্টাডি রুমের ভিডিওটা আগামী হপ্তার…হ্যাঁ, বুধবারের মধ্যে ঠিকঠাক না করে তো আমি অর্ডার বাতিল করে ঐ নষ্ট জিনিসটা ফিরিয়ে আনব।’ একটু পজ বাটন চেপে সে মনে করার চেষ্টা করে আর কী কী সমস্যা হতে পারে সে এ কদিন পৃথিবীতে না থাকলে। সাথে সাথে দমও নিয়ে নেয়ু একটু।
‘টাকা পয়সায় টানাটানি পড়লেই অফিসে কল করো। তারা আমাকে জরুরী কল করতেও পারে, আমার জবাব দেবার মতো সময় থাকবে না। বাচ্চাদের আমার ভালবাসা জানিয়ে বলো যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসছি। ওহ! ধ্যাৎ-আশপাশে এমন একজন আছে যার সাথে আমি কথা বলতে চাই না-পারলে চাঁদ থেকে কল করব-গুড বাই।’
ফ্লয়েড কোনোমতে নিজেকে বুখ থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। এরই মধ্যে থামিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। সোভিয়েত বুথ থেকে মূর্তিমান আতঙ্কের মতো উদিত হয়েছে ইউ এস এস আর একাডেমি অব সায়েন্সের ডক্টর দিমিত্রি ময়শেভিচ।
দিমিত্রি ফ্রয়েডের বেস্ট ফ্রেন্ডদের একজন; আর সেই বিশেষ কারণেই দিমিত্রি শুধু তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তার খা বলতে হবে। এখন, এখানে।
অধ্যায় ৯. চান্দ্র যান
বিশালদেহী, পাতলা রাশিয়ান এ বিজ্ঞানী হালকা চুলের অধিকারী। তার রেখাহীন মুখমণ্ডল দেখে কেউ বলবে না বয়সে সে পঞ্চান্ন বছর পেরিয়েছে।
তার মধ্যে শেষ দশটা বছর কাটলো চাঁদের অপর পিঠে দৈত্যাকার রেডিও অবজার্ভেটরিং তৈরির কাজে। সেখানে দু-হাজার মাইল বিস্তৃত পাথর অবজার্ভেটরিটাকে পৃথিবীর শব্দ-আবর্জনা থেকে রক্ষা করবে।
‘তাইতো সব সময় বলি, ফ্লয়েড’, উষ্ণভাবে হাত আঁকাতে ঝাঁকাতে বলে গেল সে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা একদম ছোট। তা কেমন আছ তুমি? আর তোমার মিষ্টি বাচ্চাকাচ্চার খবর কী?
‘আমরা ভালই আছি। যথাসম্ভব উষ্ণভাবে জবাব দেয় ফ্লয়েড, গত গ্রীষ্মে তুমি আমাদের দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলে। সেসব নিয়ে আজো কথা হয়। সে অপ্রস্তুত ভাব ঢাকার চেষ্টা করছে। গত গ্রীষ্মে আসলেই দিমিত্রির সাথে তাদের একটা উইক এন্ড কেটেছিল ভালোভাবে। রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা তখন ছুটিতে এসেছিল পৃথিবীর বুকে।
দিমিত্রি খোঁজখবর নেয়, আর যতটুকু মনে হচ্ছে, তুমি উপরের পথে, ঠিক?
‘ধ্যাৎ…হ্যাঁ-আধঘণ্টার মধ্যেই আমার ফ্লাইট ছেড়ে যাবে।’ জবাব দেয় ফ্লয়েড আমতা আমতা করে, তুমি কি মিস্টার মিলারকে চেন?
এরমধ্যেই সিকিউরিটি অফিসার এসে গেছে, একটু সম্মানসূচক দূরত্ব বজায় রেখেছে সসম্ভ্রমে। হাতে একটা কফির প্লাস্টিক কাপ।
‘অবশ্যই চিনি। কিন্তু প্লিজ কফির কাপটা নামিয়ে রাখুন। এটাই ডক্টর ফ্লয়েডের সভ্য ড্রিঙ্ক নেয়ার শেষ সুযোগ-নষ্ট না করাই ভালো সুযোগটা। চল ফ্লয়েড, একটা ড্রিঙ্ক… না-আমি অনুরোধ করছি…’।
অগত্যা তারা দুজনেই দিমিত্রির পিছু নেয় অবজার্ভেশন সেকশনের দিকে একটু পরেই তারা বসে ছিল এক মনোহর হাল্কা আলোর নিচে; দেখছিল দিগন্তজোড়া নক্ষত্রলোক। স্পেস স্টেশন ওয়ান প্রতি মিনিটে একবার গোত্তা খায় আর কেন্দ্রমুখী বলটা এই ঘূর্ণনেরই ফসল। বলের মান চাঁদের আকর্ষণের মানের কাছাকাছি। পার্থিব অভিকর্ষ একেবারেই না থাকার চেয়ে এটুকু থাকা ভালো। বরং লোকজনকে চাঁদে যাওয়ার আগে এক-আধটু চান্দ্রসুখ দেয়া যায়।
বাইরের একদম অদৃশ্য জানালা দিয়ে পৃথিবী আর তারকারাজির নিরব মহামিছিল দেখা যায়। এ মুহূর্তে সেকশনটা সূর্যের ঠিক উল্টোমুখো হয়ে থাকায় বাইরে দৃষ্টিক্ষেপের স্পর্ধা দেখানো যাচ্ছে, নইলে আলোর তোড়ে কোথায় ভেসে যেত জায়গাটা! এমনকি এখনো পৃথিবী-গোলকটা ভরে রেখেছে অর্ধাকাশ। সব ডুবে আছে অমানিশায়, শুধু মিটমিট করে উপস্থিতি জানিয়ে যায় তারার দল।
আসলে পৃথিবী প্রতীক্ষারত, এ অংশে এইমাত্র প্রবেশ করল স্টেশন ওয়ান। আরেকটু পরে রাতের দিকে গেলেই দেখতে পাবে মহানগরীর আলোকমালা। আর তখন পুরো আকাশই যেন চলে যাবে রাতের তারার দখলে।
‘তো, দ্রুত প্রথম দফা গলায় চালান করে দিয়ে দ্বিতীয়টার সাথে ক্রীড়ারত দিমিত্রি খেই ধরতে চাচ্ছে, চাঁদের ইউ এস সেক্টরে কীসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে হৈচৈ চলছে? এবারের ট্রিপে যেতে চেয়েছিলাম, ‘নো, প্রফেসর।‘’ জবাব মিলল? ‘উই আর ভেরি স্যরি, কিন্তু পরের নোটিশ না আসা পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বহাল রয়েছে।’ ক্ষেপে গিয়ে তার ধরে টানাটানি করেছিলাম, কারণ সেটা কোনো কাজেই লাগতো না। তো, তুমিই বল, হচ্ছেটা কী?’
ভিতরে ভিতরে গড়গড় করে কী যেন বলল ফ্লয়েড। আবারও এসব কথা! যত জলদি মুন শাটলে সেঁধিয়ে যেতে পারি, ততই বাঁচোয়া।
‘এই-এহ্-কোয়ারেন্টাইন একদমই নিরাপত্তার পদক্ষেপ।’ অতি সাবধানে বেচারা বলে চলে, আমরা ঠিক শিওর না এর দরকার আছে, নাকি নেই। কিন্তু ঝুঁকি নিতে নারাজ। এই আর কী!’