ওরিয়ন থ্রি স্পেসক্র্যাফট একটা উচ্চ শক্তির অর্কিট থেকে বেরিয়ে আসছিল বলে পৃথিবীকে স্টেশনের পেছনে অবাক করা রূপে দেখা যায়। দু’শ মাইল উচ্চতা থেকে ফ্লয়েড স্পষ্ট দেখতে পায় আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল আর সুবিশাল অতলান্তিককে। যথেষ্ট মেঘ আছে। তবু গোল্ড কোস্টের[১৪] সবুজ সীমারেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ডকিং আর্ম সহ স্পেস স্টেশনের কেন্দ্রীয় অক্ষ বেরিয়ে আসছে। যেন সতরে আসছে মহাকাশের মহানদী বেয়ে। কেন্দ্রীয় অক্ষের ধারক অংশ, অক্ষ, ডকিং আর্ম একেবারেই ঘুরছে না। আরেকভাবে বলতে গেলে উল্টো হয়ে যায়, এগুলো ঘুরছে এবং বেশ ভালোভাবেই ঘুরছে। স্পেস স্টেশনের বাকী অংশের বিপরীত গতিতে ঘোরায় স্থির মনে হয়। এ অক্ষ স্থির না থাকলে আসতে থাকা কোনো স্পেসক্রাফট এর সাথে যুক্ত হতে পারবে না। তাই সেই আগুয়ান খানের সাপেক্ষে স্থির থাকতে হচ্ছে। মানুষ আর জিনিসপাতির দঙ্গলকে নামানোর ক্ষেত্রে দারুণ অসুবিধা হতো যদি স্পেস স্টেশনের মতো এটাও ঘুরে চলত ভয়ংকরভাবে।
একেবারে হাল্কা আওয়াজ তুলে, ক্ষীণ ধাক্কা দিয়ে স্টেশনের সাথে মহাকাশযান মিলিত হল। বাইরে থেকে ধাতব ঘষটানোর শব্দ আসে। বাতাস আর বায়ুচাপের সমন্বয় আর সমতার জন্য হালকা হিসহিস শব্দও ওঠে। কয়েক সেকেন্ড পরেই স্পেস স্টেশনের হালকা ইউনিফর্ম পরা এক লোক ভিতরে এল।
‘আপনার দেখা পেয়ে খুশি হলাম, ডক্টর ফ্লয়েড। আমি নিক মিলার, স্টেশন সিকিউরিটি; শাটল ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত আপনার দেখভালের দায়িত্বটা আমার কাঁধেই পড়েছে।’
তারা হ্যান্ডশেক করার পর ফ্লয়েড বিমানবালার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দেয়, ‘প্লিজ, আমার পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন টিন্স আর কো পাইলটকে ধন্যবাদ দিও। আশা করি যাবার পথে তোমাদের সাথে দেখা হবে।’
খুব সতর্কভাবে সে নড়াচড়া করছে, কারণ প্রায় বছরখানেক হতে চলল সে ওজনশূন্যতায় পড়েনি। ওজনহীনতায় চলাফেরার অভ্যাসটা ফিরে আসতে একটু সময় নেবে; লোকে অভ্যাসটাকে বলে স্পেসলেগ অর্থাৎ কিনা মহাকাশের অদৃশ্য পা। নিজেকে ঠিক রাখতে এয়ারলকের ভিতর দিয়ে স্পেস স্টেশনের গোলাকার ঘরটায় যেতে যেতে সে হাত ঠেকায় উপরের দেয়ালে। এই ঘরে ভালোমতো প্যাড লাগানো হয়েছে, তার উপর চারদিকে গিজগিজ করছে হ্যান্ডহোন্ড। পুরো চেম্বারটা ঘুরতে শুরু করেছে। এবার ফ্লয়েড একটা হ্যান্ডহোল্ড ধরে বসে ঠিকমতো। এই ঘুর্ণণ এক সময় স্পেস স্টেশনের ঘোরার দিকে একইভাবে চলতে থাকবে।
গতি বাড়তে শুরু করলেই অভিকর্ষের ভৌতিক আঙুল এসে তাকে খোঁচাতে থাকে আর সে ধীরে ভেসে যায় দেয়ালের দিকে। এবার সে এর উপরে সামনে পেছনে দৌড়ে দাঁড়িয়ে থাকছে যেভাবে কোনো সমুদ্রের বিশেষ স্রোত প্রবাহে প্রবাল গড়িয়ে চলে। নিচের মেঝেটাকে কুঁকড়ে যেতে দেখা কী ভয়াবহ ব্যাপার! অবশেষে স্টেশনের কেন্দ্রমুখী বল তার দখল নিয়ে নিল। কেন্দ্রের দিকে বলটা বেশ দুর্বল হলেও পরিধির দিকে যেতে থাকলে ক্রমান্বয়ে বাড়বে।
সেন্ট্রাল ট্রানজিট চেম্বার থেকে ফ্লয়েড মিলারকে অনুসরণ করে একটা বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। প্রথমদিকে বল এত কম ছিল যে নিচে নামতে হলে জোর দিয়ে নামতে হয়েছে। সে এই বিশাল ঘুরন্ত চাকতির একেবারে বাইরের দিকে চলে এল। এবার একটু একটু স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করা যাচ্ছে।
গত এক বছরে লাউঞ্জটাকে নানা সুবিধা দিয়ে নতুন করে সাজানো হয়েছে। আগের ছোট চেয়ার, নিচু টেবিল, রেস্তরা আর পোস্ট অফিস ছাড়াও এবার এতে একটা করে চুল কাটার দোকান, স্যুভেনির শপ, ওষুধের দোকান আর আস্ত থিয়েটার বসানো হয়েছে। স্যুভেনির শপটায় পৃথিবী আর চাঁদের চমৎকার সব প্রাকৃতিক দৃশ্য, গ্যারান্টি দেয়া চাঁদের পাথর, সব বড় অভিযাত্রী আর বড় বড় মানুষের মূর্তি পাওয়া যায় প্লাস্টিকে, শুধু দামটাই অবিশ্বাস্য চড়া।
‘অপেক্ষা করার সময় কিছু খাবেন? হাতে আরো ত্রিশ মিনিট সময় আছে।’
‘দু-টুকরো চিনির সাথে এককাপ ব্ল্যাক কফি। আর কল করতে চাই পৃথিবীতে।’
‘ঠিক আছে, ডক্টর। আমি কফি আনছি, ফোনগুলো ঐদিকে।’
ফোনবুথের সামনে দুটো বাঁধা, একটায় লেখা ‘সোভিয়েত সেকশনে স্বাগতম’ আর অন্যটায় আছে, ‘ইউ এস সেকশনে’ স্বাগতম। নিচেই স্প্যানিশ, রাশিয়ান, ইংলিশ, চাইনিজ, ফ্রেঞ্চ আর জার্মান ভাষায় লেখা:
দয়া করে প্রস্তুত করুন আপনার:
পাসপোর্ট
ভিসা
মেডিক্যাল সার্টিফিকেট
যাতায়াতের অনুমতিপত্র
ওজনের ঘোষণা
এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সুবিধাজনক বলতে হয়। কারণ একাধিক বুথ থাকছে। এই বুধগুলো থেকে বেরুতে পারলেই যাত্রীরা মিলেমিশে আবার এক হয়ে যায়। তখন কোনো সোভিয়েত–মার্কিন ঘেঁষাঘেঁষি নেই। এ বিভক্তি শুধুই প্রশাসনিক।
ফ্লয়েড আবারো দেখে নেয়। না, ইউ এস এরিয়া কোড আজো একাশিই রয়ে গেছে। তারপর নিজের বাসার বারো সংখ্যার নম্বরটায় ডায়াল করে। সকল কাজের কাজি প্লাস্টিক ক্রেডিট কার্ডটা পরিশোধ স্লটে প্রবেশ করিয়ে আধ মিনিট অপেক্ষা করেই বাসায় লাইন পেয়ে গেল।
ওয়াশিংটন এখনো ঘুমের রাজ্য, কারণ ভোর হতে কয়েক ঘণ্টা বাকী, কিন্তু সে কাউকে বিরক্ত করবে না। জেগে ওঠার সাথে সাথেই হাউসকিপার কল পেয়ে যাবে।