কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা লালচে বেগুনী, গোলাপী, সোনালী আর নীল পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে চোখ ধাঁধানো সাদায়। জানালাগুলো আলোর তীব্রতা প্রতিরোধের জন্য ভালমতো রঙচঙা করা হয়েছে। তার পরও সূর্যের অত্যুৎসাহী সর্বগ্রাসী আলো ফ্লয়েডের চোখে সামান্য সময়ের জন্য একটা রশ্মি বুলিয়ে দিয়ে বেচারাকে কয়েক মিনিটের জন্য একদম অন্ধ করে দিয়ে গেল। সে আসলেই মহাকাশ ভ্রমণ করছে, কিন্তু হায়, নক্ষত্র দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
চোখগুলোকে হাতে ঢেকে নিয়ে সে বাইরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা চালায় একটু। সেখানে দিনের আলোয় বাড়তি ডানাটা তপ্ত ধাতুর মতো চকচক করছে। চারপাশে অসীম আঁধার, সে অন্ধকারটা নিশ্চয়ই তারায় তারায় ভরা! দেখাই যায় না সেগুলোকে।
ধীরেসুস্থে ফিরে আসছে ওজন। শিপ নিজেকে অর্বিটে বসিয়ে নেয়ার সাথে সাথে নিভে গেছে রকেটের জ্বালামুখ। ইঞ্জিনের বজ্রপাতগুলো মিইয়ে আসে, তারপর চাপা একটু হিসহিসানি, সবশেষে পথ খুঁজে নেয় নিরবতার ভিতরে। পুনঃশক্তি সংগ্রহ স্ট্রাপ না থাকলে ফ্লয়েড ঠিকই সিট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত; কারণ তার পাকস্থলি বিপদসংকেত জানান দিচ্ছে। তার প্রাণান্ত ভাবনা, আধঘণ্টা আগে দশ হাজার কিলোমিটার দূরে যে পিলগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো আশানুরূপ কাজ দেবে। অবশ্য জীবনে মাত্র একবারই স্পেসসিক হয়েছিল। সী সিকনেস, স্পেস সিকনেস…যত্তসব! এ অবস্থাটা সহজে আসেও না।
কেবিনের স্পিকারে ভেসে আসা পাইলটের স্বর স্থির আর অবিচল, অনুগ্রহ করে জিরো জি’র সব নিয়মকানুন দেখে নিন। আমরা স্পেস স্টেশন ওয়ান এর সাথে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে মিলিত হব।’
স্টুয়ার্ডেস সিটগুলোর মাঝের সরু জায়গা পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। তার পদক্ষেপে কিছুটা অস্বাভাবিকতা। যেন পা প্রতিবার মেঝেতে পড়ে যাবার পরই আঠায় আটকে যাচ্ছে। সে পা রাখছে ফ্লোরে বিছানো ভেলক্রো কার্পেটে। এ কার্পেট আছে ছাদের গায়েও। কার্পেট আর তার স্যান্ডেলের সুখতলি অতি সূক্ষ্ম হুক দিয়ে ঢাকা। হুকগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে পারে ঠিকমতো। চলাচলের এই কৌশল এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকা অনভ্যস্ত যাত্রীদের এক কাতারে দাঁড় করায়, বাঁচায় অস্বস্তির হাত থেকে।
‘আপনি কি একটু চা বা কফি পান করবেন, ডক্টর ফ্লয়েড?
‘না। ধন্যবাদ তোমাকে।’ একটু হেসে জবাব দেয় সে। ঐসব টিউবওয়ালা জিনিসে করে কিছু খেলে নিজেকে সব সময় একেবারে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়।
যখন সে ব্রিফকেস খুলে কাগজপত্র ঢোকাচ্ছে তখনো মেয়েটা আগের মতোই ঘুরঘুর করছে আশপাশে।
‘ডক্টর ফ্লয়েড, একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?’
‘অবশ্যই।’ চশমা পরে তাকাতে তাকাতে উত্তর দেয় সে।
‘আমার… হবু বর ক্ল্যাভিয়াসের একজন ভূতত্ত্ববিদ।’ স্পষ্ট করে নিজের প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করছে সে, ‘এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ওর সাথে কথা হয় না।’
‘দুঃখ পেলাম শুনে। হয়তো সে কাজের জন্য বাইরে গেছে। চাঁদে দিন সাতেক বেসের বাইরে থাকা বিচিত্র কিছু নয়।’
সাথে সাথেই মাথা নাড়ে মেয়েটা, এমন হয়, কিন্তু আগে আগেই ও আমাকে বলে রাখে। সব সময়। বুঝতেই পারছেন এ পরিস্থিতিতে আমি কীরকম ভেঙে পড়েছি চারপাশের গুজব শুনে। আসলেই কি চাঁদে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে?
‘এমন হয়ে থাকলে যোগাযোগ বন্ধ হবে কোনো দুঃখে? আর হলে সতর্ক হওয়ারও কিছু নেই। দারুণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেখানে। আটানব্বইয়ের কথা মনে আছেতো? ফ্লু ভাইরাস বিবর্তিত হয়ে অ্যাটাক করেছিল। অনেক লোক অসুস্থ হলেও কেউ মারা যায়নি। আসলে এটুকুই আমি বলতে পারি। এরচে বেশি এক কণাও না। ভদ্রভাবে শেষ করে সে কথাটা।
মিষ্টি করে হেসেই সুদর্শনা মিস সিমন্স সোজা উপরদিকে চলে যায়।
‘আচ্ছা, ধন্যবাদ, ডক্টর, আপনাকে বিরক্ত করায় আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
‘একটুও বিরক্ত করোনি।’ সে উষ্ণভাবে বললেও কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। এরপরই নিজেকে ডুবিয়ে দেয় টেকনিক্যাল রিপোর্টের অথৈ সাগরে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যয় করে পেছনের দিনগুলোর কাজের তালিকায় মগ্ন হয়ে।
একবার চাঁদে পৌঁছে গেলে আর পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে না।
অধ্যায় ৮. কক্ষপথে দেখা
আধঘণ্টা পরে পাইলট ঘোষণা করল, ‘আর দশমিনিটের মধ্যেই যোগাযোগ স্থাপন করছি। প্লিজ সিট হার্নেসটা দেখে নিন।’
বাধ্য ছেলের মতো ফ্লয়েড কথাটা পালন করে নিজের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে। শেষদিকের অর্বিটের ঝাঁকিতে পড়াশোনা করা খুব একটা ভালো না–এমন কথা বলা হয়। এ অবস্থা চলছে গত তিনশো মাইল জুড়ে আসার সময়। এ সময়টায় বরং চোখ বন্ধ করে রাখাই শ্রেয়। কারণ রকেটের হঠাৎ প্রজ্বলন বেশ ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করে।
কয়েক মিনিট পরেই সে চোখের সামনে কয়েক মাইল দূরে আবছায়ার মতো হালকাভাবে স্পেস স্টেশন ওয়ানকে দেখতে পেল। মানুষ কোথায় চলে গেছে! সে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে যায়, পৃথিবী থেকে যায় চাঁদে; মধ্যিখানে শূন্যের স্টেশনেও একটু জিরিয়ে নেয়। স্টেশনের পালিশ করা ধাতব গায়ে সূর্যালোক যেন পিছলে যাচ্ছে সারাক্ষণ। প্রায় দু’শ আশি মিটার ব্যাসের চাকতিটা খুব বেশি দূরে নয়। একটা টিটভ ফাইভ শ্রেণীর স্পেসপ্লেন ধীরে ভেসে বেরিয়ে আসছে একই অর্বিট ধরে। দেখতে প্রায় একটা এ্যারেস ওয়ান বি ওয়ার্ক হর্সের মতোই। এর পা-গুলোও চাঁদে অবতরণের উপযোগী করে তৈরি করা। চার পা-ই শক অ্যাবজর্ভিং।