নিজের আসনে হেলান দিয়ে এবার সে একটু আরাম করে নেয়। এ ট্রিপের জন্য করদাতাদের ঘাড়ে এক মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি বোঝা চাপবে। কিন্তু সে জানে, তার কাজে সে ঠিকই পারঙ্গম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনে ফিরে গেলেই কি বেশ হয় না? একটা গ্রহ-জগৎ তথা প্ল্যানেটারি সিস্টেমের গঠন নিয়ে করতে থাকা গবেষণার বাড়তি কাজটা আর শেষ হলো না। কিন্তু আজ আর বয়েস নেই। কাজটাতো অন্যভাবেও করা যায়।
‘স্বয়ংক্রিয় কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যাচ্ছে এখন,’ ক্যাপ্টেনের স্বর ভেসে আসে স্পিকারের ভিতর দিয়ে। টি চ্যাটের মাধ্যমে হালকা কোমল গানও ভেসে আসছে।
‘উপরে উঠছি এক মিনিটের মধ্যেই।’
আর সব সময়ের মতো আজো এ মুহূর্তটুকুকে একটা ঘণ্টার মতো লম্বা মনে হয়। তার চারপাশ পেচিয়ে যে দানবীয় শক্তি কাজ করছে সে সম্পর্কে মুহূর্তেই সচেতন হয়ে ওঠে সে। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। দুটো স্পেসক্রাফটের জ্বালানী ট্যাঙ্ক আর লঞ্চিং ট্র্যাকের শক্তি সংগ্রহ সিস্টেমে প্রায় একটা পারমাণবিক বোমার সমান শক্তির যোগান দেয়া হয়েছে। এর সবটুকু ব্যয় হয় শুধু তাকে পৃথিবী থেকে মাত্র দু’শ মাইল উপরে উঠিয়ে নিতে।
আজকাল কাউন্ট ডাউনে আর মান্ধাতা আমলের ফাইভ-ফোর-থ্রি-টু-ওয়ান জিরোর কারবার নেই। সেগুলো মানুষের স্নায়ুতে বেশ ভালো চাপ ফেলে।
‘পনের সেকেন্ডের মধ্যে উড্ডয়ন। ভালো লাগবে যদি গভীর করে শ্বাসপ্রশ্বাস নেন।’
এটা দারুণ মনস্তত্ত্ব আর শরীরতত্ত্বের সংমিশ্রণ। ফ্লয়েড নিজেকে অক্সিজেনে যথাসম্ভব টইটম্বুর করে নেয়। প্রস্তুত করে নেয় যে কোনো কিছুর জন্য। এই বিশাল যানটা তার হাজার টনী শরীর নিয়ে আটলান্টিকের উপর উড়ছে বর্তমানে।
কখন তারা ট্রাক ছেড়ে আকাশের সন্তান হয়েছে তা কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারবে না কিন্তু রকেটের তর্জনগর্জন দ্বিগুণ হয়ে যাবার সাথে সাথে সিট কুশনের আরো আরো গভীরে ডুবে যায় ফ্লয়েড। ফার্স্ট স্টেজ ইঞ্জিন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খুব ইচ্ছা হয় একবার বাইরে চেয়ে জিনিসটার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া দেখতে, কিন্তু নিজের ঘাড়টা ফেরানোও এখন নিতান্তই কষ্টকল্পনা। অবাক হলেও সত্যি, এখনো আরামের একবিন্দু কমতি নেই। বরং গতিবৃদ্ধির দুর্দান্ত চাপ আর মোটরগুলোর দারুণ গর্জন এক আধিভৌতিক চরম শিহরন এনে দেয়। কান ঝাঁঝ করছে, রক্তপ্রবাহ শিরা উপশিরায় দেবে দেবে যাচ্ছে, এবার আবারো ফ্লয়েড বাকী জীবন থেকে বেশি ‘জীবন্ত’ হয়ে উঠছে। আবার ফিরে এসেছে দুর্দান্ত তারুণ্য, আবার তার গলা ফাটিয়ে গাইতে ইচ্ছা করছে। গাওয়ার কাজটা এক্কেবারে নিরাপদ, কোনো ব্যাটার শোনার ক্ষমতা নেই ইঞ্জিনের এই গগনবিদারী তারস্বরের সামনে।
স্ফূর্তির ভাবটা কেটে গেল জলদি জলদিই। মনে পড়ে গেছে যে সে পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে সারা জীবনের সবটুকু ভালবাসা। নিচে তার তিন সন্তানের বাস, তিন এতিম সন্তান! দশ বছর আগে তাদের মা ইউরোপের সেই মরণ প্লেনে ওঠার পর…(দশ বছর? অসম্ভব! এখনো মনে হয় যেন…) তাদের জন্য হলেও তার বিয়ে করা উচিত ছিল আবার…
যখন চাপ আর শব্দ আস্তে আস্তে কমে আসে আর কেবিনের লাউড স্পিকার চেঁচিয়ে ওঠে, এবার লোয়ার স্টেজ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, শুরু হল…’ তখনো সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কতটা সময় পেরিয়েছে এতক্ষণে।
একটা ছোট ঝুঁকির সাথে সাথে আবার মনে পড়ে যায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সেই প্রদর্শনীর কথা। সেটা দেখেছিল নাসা অফিসে:
মহাপাখির পিঠে আরেক মহাপাখির উড্ডয়ন হবে, যে কুটিরে এর জন্ম সেটা গর্বে হবে উজ্জ্বলতর।
আচ্ছা, আজ সেই দ্য গ্রেট বার্ড উড়ছে, দ্য ভিঞ্চির সবটুকু স্বপ্নকে পুঁজি করে উড়ছে। এর ছেড়ে দেয়া সাথী ফিরে চলেছে পৃথিবীতে। দশ হাজার কিলোমিটারের ধনুক তৈরি করে খালি পোয়ার স্টেজটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাবে। এর কাজ বাড়তি গতি দেয়া। মূল যানকে একটু উঠিয়ে দিয়ে পরের বার একই কাজ করার জন্য ফিরে যাবে নিজের বাড়িতে, কেনেডিতে। কয়েক ঘণ্টায় জ্বালানী ভরে নিয়ে, ঘষামাজা শেষ হলে আবার নতুন কোনো সঙ্গীকে উপরের জ্বলজ্বলে নিরবতায় উঠিয়ে দিতে প্রস্তুত হবে। সব সঙ্গীকে সেই উচ্চতায় পৌঁছে দেবে যেখানে সে নিজে যেতে পারবে না কোনোদিন।
এতক্ষণে-ভাবছে ফ্লয়েড-আমরা অর্বিটের বেশিরভাগ পৰ্থ পেরিয়ে এসেছি। আপার স্টেজের রকেট জ্বলে উঠল; আবার ফিরে এল ত্বরণ। এবারের গ্র্যাভিটিটা অনেক বেশি ভদ্রগোছের। আসল কথা, স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে এক বিন্দু বেশি অনুভূত হয় না। কিন্তু হাঁটার চিন্তা নিতান্তই অবান্তর, কারণ আকর্ষণ ফিরে এসেছে ঠিকই, উল্টো দিকে। তার মাথার পিছন দিকটাই এখন নিচ। সে যদি সিটবেল্ট ছেড়ে দেয়ার মতো বোকা হয়, তাহলে সোজা গিয়ে পড়বে কেবিনের পেছনে, দেয়ালে।
এই কিম্ভুত মনোভাব কেটে যাবে যদি ভাবা যায় যে শিপ দাঁড়িয়ে আছে লেজের উপর, আরাম করে। ফ্লয়েড দেখে বাকী সব সিট তার কাছে নিচের দিকের মই বা সিঁড়ির ধাপের মতো লাগছে, কারণ সে সবচে সামনের আসনে বসা। সূর্যালোকে তরীর বাইরের দিকটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ডক্টর ফ্লয়েড এই সম্মোহন কাটানোর চেষ্টা করে প্রাণপণে।