‘এখনো, কোনো কথা নয়।
‘ডক্টর ফ্লয়েড!’ দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক অতি খাটো আর পরিশ্রমী মহিলা প্রেসকর্মী, চাঁদের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধের কী ব্যাখ্যা করবেন আপনারা? এর সাথে রাজনীতির ঘোঁট পাকানোর কোনো সম্বন্ধ নেইতো?’।
‘রাজনীতির কোন ঘোঁট পাকানো?’ কাঠখোট্টা বে রহম সুরে ডক্টর ফ্লয়েড প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। হাসির ছোটখাট ফোয়ারা ছুটে যায় চারদিকে। হাল না ছাড়া সাংবাদিকের দল এবার বিদায় দেয় অপ্রসন্নচিত্তে, হ্যাভ এ গুড ট্রিপ, ডক্টর।
সাংবাদিকরা যে এমনি এম্নি ছেড়ে দিয়েছে তা নয়। ফ্লয়েড আগেই ঢুকতে শুরু করেছিল গ্যানট্রির নিরাপত্তা বেষ্টনীতে।
যদ্দুর তার মনে হয়, এটা কোনো বড়সড় স্থায়ী সংকট নয়। উনিশশো সত্তরের পর থেকে পৃথিবীকে দু সমস্যা নিয়ে বিভক্ত করা হয় আর তার একটা দিয়ে অন্যটাকে কাটিয়ে দেয়া যায়।
যদিও জন্মনিয়ন্ত্রণ সহজ, স্বল্প ব্যয়ের প্রক্রিয়া, এবং সব ধর্ম অনুমোদিত-তবু অনেক দেরি হয়ে গেছে; আজ পৃথিবীর জনসংখ্যা ছ বিলিয়ন; ছ’শ কোটি। আর তার এক তৃতীয়াংশ চৈনিক সাম্রাজ্যে। দু-সন্তান নিয়ে আইন, সুযোগ-সুবিধা আর প্রচারণা করা হয়েছে বেশ। কিন্তু সেসবের প্রয়োগ হয়নি ঠিকমতো। ফলে প্রতি দেশেই খাদ্যের চরম সংকট। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও মাংসহীন দিবস রয়েছে। পনের বছরের সংকটময় মঙ্গা মানুষকে সাগরের দ্বারস্থ করে, সিন্থেটিক ফুডের খোঁজে লেগে যায় সবাই।
এর আগে কখনোই আন্তর্জাতিক সহায়তা আর সুসম্পর্ক এত জরুরী ছিল না। অথচ আজকের মতো এত বেশি হবু রণাঙ্গনও ছিল না আগে কখনো। লাখো বছরে মানবজাতি তার হিংস্রতার খুব একটা খোয়াতে পারেনি। সিম্বলিক চিত্রগুলি শুধু রাজনীতিবিদদের চোখেই ধরা পড়ে; আটত্রিশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অন্যের উপর অহর্নিশি শ্যেন দৃষ্টি রেখে চলেছে। তাদেরকে আবার অনেক অনেক মেগাটন পারমাণবিক বর্জ্য সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবীর আহত বুক থেকে। অথচ, অবাক লাগলেও সত্যি কথা, কখনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। অবশ্য এই অবস্থা যে কদ্দিন চলবে তা কেউ জানে না।
আর আজকাল চীন তাদের প্রয়োজনের খাতিরে নতুন ছোট দেশ এবং গোষ্ঠীর একেবারে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসে পঞ্চাশ ওয়্যারহেডসম্পন্ন একটা পরিপূর্ণ পারমাণবিক যুদ্ধক্ষমতা। খরচ পড়বে বিশ কোটি মার্কিন ডলারেরও কম। এ বিকিকিনি নিয়ে সরকারের সাথে যে কোনো সময় যোগাযোগ করা যায়। সেই ঢিমেতাল সরকারি লাল ফিতার দৌরাত্ম এই একটা ক্ষেত্রে নেই।
চৈনিকরা নিজেদের ভয়ানক অস্ত্রের ভান্ডারকে হার্ড মানিতে পরিণত করে ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে চাইছে-এ মতো কেউ কেউ দেন। অথবা তারা এমন ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করেছে যার সামনে এসব খেলনার আর কোনো দাম নেই। লোকজন বলে বেড়ায় যে রেডিও হিপনোসিস বা দূর থেকে সম্মোহিত করার পদ্ধতি বের করেছে অনেকেই। দূর-সম্মোহন করা যায় সামান্য স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। অনেকে বলে শক্তিময় ভাইরাসের কথা। এমন সব কৃত্রিম রোগের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করার জোর গুজব রটেছে বাজারে যেগুলোর ওষুধ শুধু রোগের স্রষ্টার কাছেই পাওয়া যাবে। মজার আইডিয়াগুলো হয় স্রেফ অপপ্রচার, নয়তো অলীক কল্পনা। কিন্তু এসব ধারণার কোনোটাকেই মাথা থেকে তাড়িয়ে দেবার তিলমাত্র জো নেই। প্রতিবার ফ্লয়েড পৃথিবী ছাড়ার সময় আরেক ভয় পায় ফিরে এসে গ্রহটার দেখা পাবো তো? কে জানে!
কেবিনে ঢোকার সাথে সাথে বিমানবালা তাকে স্বাগত জানাল। মুখে মাপা হাসি, ‘গুডমর্নিং, ডক্টর ফ্লয়েড, আমি মিস সিমন্স- আপনাকে এখানে আমাদের ক্যাপ্টেন টিন্স আর কো পাইলট, ফাস্ট অফিসার ব্যালার্ডের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে বলতেই ডক্টর ফ্লয়েড ভাবে, কেন যে স্টুয়ার্ডেসগুলো সারা জীবন রোবট স্পেস গাইডের মতো কথা বলে আল্লা মালুম।
‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই টেক অফ হবে,’ বিশজন যাত্রীর খালি কেবিনটার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে মেয়েটা বলছে, যে কোনো সিটে বসতে পারেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন টিন্স মনে করেন আপনি ডকিং অপারেশন দেখতে চাইলে প্রথম জানালার বামপাশের আসনটায় বসলে ভাল হয়।
‘তাই করব আমি।’
মাথার উপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে মহাকাশবালা বেরিয়ে যায়। কারণ তার কিউবিকলটা পেছনদিকে।
জায়গামতো বসে ফ্লয়েড সেফটি হার্নেস জড়িয়ে নেয়; বেঁধে নেয় কাঁধ। তারপর ব্রিফকেসটা রাখে সামনে। মুহূর্তখানেক পরেই লাউডস্পিকার মৃদু বাড়তি শব্দ করে সরব হয়ে উঠল, ‘শুভ সকাল,’ বলছে মিস সিমন্সের গলা, ‘এটা স্পেশাল ফ্লাইট থ্রি, কেনেডি থেকে স্পেস স্টেশন ওয়ানের দিকে যাত্রা করব আমরা।’
ব্যাপারস্যাপার দেখে মনে হয় এই মেয়ে পুরো পোশাকী রীতি মেনে চলতে একেবারে যাকে বলে বদ্ধপরিকর। এবার আর ডক্টর ফ্লয়েড হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ ঠিক সেভাবেই হোস্টেসের কথা এগিয়ে যাচ্ছে।
‘আমাদের ট্রান্সমিট টাইম হবে পঞ্চান্ন মিনিট। সর্বোচ্চ ত্বরণ হবে টু জি২, আর ওজনশূন্য থাকব ত্রিশ মিনিটের জন্য। নিরাপত্তা বাতি জ্বলার আগ পর্যন্ত সিট ছাড়বেন না, প্লিজ।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো ফ্লয়েড, বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
জবাবে তার পাওনা হয় একটা হালকা, মিষ্টি, সুন্দর, মনোহর কিন্তু চরম পেশাদার হাসি।