তার শরীর আরো প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ার সাথে সাথে শত্রুরাও বেশি বেশি ভীত হয়ে পড়ে। স্টোন আর ব্রোঞ্জ আর আয়রন আর স্টিলের কাল আসার সাথে সাথে সে প্রতিটা জিনিসকে পরখ করে দেখেছে, যা ভাঙা যায়, যা চিরে দেখা যায় এমন সব কিছুকেই। কিছুদিনের মধ্যেই শত্রুকে দূর থেকে ঘায়েল করার কূটবুদ্ধিও তার দখলে চলে আসে। তীর, ধনুক, বন্দুক আর সবশেষে গাইডেড মিসাইল” তাকে দিয়েছে অসীম পাল্লা, দিয়েছে আর সব; শুধু দেয়নি অসীম ক্ষমতা।
মাঝে মাঝে নিজেরই বিরুদ্ধে নিজের ব্যবহার করা এসব মারণাস্ত্র ছাড়া মানব কখনোই পৃথিবীর অধীশ্বর হতে পারত না। এ কাজেই সে নিজের সবটুকু দক্ষতা ঢেলে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে সেগুলো কাজও দিয়েছে বেশ।
কিন্তু আজ সহসাই সে সেসব রক্ষাকারীর কারণেই জীবন চালাচ্ছে ধার করা সময়ের উপর ভর করে।
২. টি এম এ-১
দ্বিতীয় পর্ব : টি এম এ-১
অধ্যায় ৭. স্পেশাল ফ্লাইট
যতবারই পৃথিবী ছেড়ে যাই না কেন, ডক্টর হেউড ফ্লয়েড আপনমনে বিড়বিড় করছে, যাবার উত্তেজনা সব সময়ই নতুন। তার মঙ্গলে যাওয়া হল একবার, চাঁদে তিনবার আর বাইরের স্পেস স্টেশনগুলোতে যে কতবার তার ইয়ত্তা নেই। অথচ আজো টেক অফের মুহূর্তটা এগিয়ে এলেই একটা বাড়ন্ত টেনশন টের পায়। বিস্ময় আর ভয়ের এক অনুভব-এবং, হ্যাঁ, সাথে একটু নার্ভাসনেস–সাথে সাথে সেই পুরনো পাগলামি, ঘরকুনো কুয়োর ব্যাঙের মতো পৃথিবীর প্রতি টান। যে কোনো কূপমণ্ডুক পৃথিবীপ্রেমী প্রথমবার গ্রহ ছেড়ে যাবার সময় যেমন অনুভব করে, ঠিক তেমনি।
মাঝরাতে প্রেসিডেন্টের সাথে ব্রিফিং ছিল। ব্রিফিংয়ের পর যে জেটটা তাকে ওয়াশিংটন থেকে উড়িয়ে এনেছে সেটা হারিয়ে যাচ্ছে অতি পরিচিত এক পরিবেশের ওপাশে। আজো তার কাছে চারপাশের দৃশ্যটা অপার্থিব মনে হয়। এখানেই স্পেস এজ বা নাক্ষত্রিক কালের প্রথম দু প্রজন্মের উত্থান; ফ্লোরিডার সাগর তীরের বিশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। দক্ষিণটা মিশে গেছে মিটমিটে লাল ওয়ার্নিং লাইটের আলোয়; শেষ মাথা উদ্ভাসিত হয়ে আছে স্যাটার্ন আর নেপচুনের পথের গ্যানট্রিতে। দূরতম প্রান্তে দেখা যায় আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া রূপালী বিশাল জাতীয় মিনারটা। এটা সর্বশেষ স্যাটার্ন ভি’ স্মৃতিস্তম্ভ। পাদদেশে নিয়মিত সম্মেলন আর মেলা বসে।
কাছাকাছিই, আকাশের বিপরীতে দেদীপ্যমান এক বিশাল ভবন। ঠিক যেন মানুষের গড়া পর্বত। ‘দ্য ভেহিকল অ্যাসেম্নি বিল্ডিং’ আজো পৃথিবীর বুকে সবচে বড় কীর্তি।
কিন্তু এসবই অতীতের সম্পদ, আর তার যাত্রা ভবিষ্যতের পথে। বালুকাবেলার দিকে যেতে যেতে ডক্টর ফ্লয়েড তার নিচে বিল্ডিংয়ের গোলকধাঁধা দেখতে পায়, এরপরই এক বিশাল এয়ারস্ট্রিপ; তার পর এক চওড়া, মরার মতো সোজা দাগ চোখে পড়ে। এটাই সেই দানবীয় লঞ্চিং ট্র্যাক, নিচের দাগগুলো সেই ট্র্যাকের রেলপথ। শেষমাথা যানবাহন আর গ্যানট্রিতে বোঝাই; আরেক কোণায় উজ্জ্বল আলোর ভুবনে বসে আছে এক ঝকঝকে স্পেসপ্লেন। যে কোনো সময় উড়াল দিতে পারবে তারার দেশে। আচমকা সে ভুলে বসেছে নিজের উচ্চতাকে, হঠাৎই তার মনে হয় নিচে বুঝি এক সুন্দর রূপালী শুয়োপোকা বসে আছে কোনো টর্চের আলোর সামনে।
এরপর ছোট ফ্লুয়িং যন্ত্রপাতিগুলোর আকার তার সামনে সেই ‘মথ’ এর প্রকৃত গড়ন ধরিয়ে দেয়। এটার ডানার সবচে চিকন ভি আকৃতির জায়গাতেও বিস্তার হবে কমপক্ষে দু’শ ফিট। আর ঐ অসম্ভব বড় যানটা-ডক্টর ফ্লয়েড অবিশ্বাসী আর গর্বিত মনে নিজেকে শোনায়-অপেক্ষা করছে শুধু আমার জন্য। যতটুকু তার মনে পড়ে, মাত্র একজনকে চাঁদে বয়ে নেয়ার জন্য এর আগে কোনো মিশন সেট করা হয়নি।
যদিও এখন ভোর দুটো, একদল সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যান তাকে ঘেঁকে ধরে ওরিয়ন থ্রি স্পেসক্র্যাফটের ফ্ল্যাডলাইটের আলোয়। সে ন্যাশনাল কাউন্সিল অন অ্যাস্ট্রোনটিক্সের চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের অনেককেই আগে থেকে চিনত। আমেরিকার জাতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান কাউন্সিলের সভাপতি হওয়াটাতো চাট্টিখানি কথা নয়। হাজার হলেও, সাংবাদিক সম্মেলন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এখানে এমন কিছু আয়োজনের সময় সুযোগ বা স্থান-কোনোটাই নেই। সবচে বড় কথা, তার বলার কিস্যু নেই; তাতে কী, কম্যুনিকেশন মিডিয়ার লোকজনকে আঘাত দিয়ে কথা না বলাই সুবোধ বালকের কাজ।
‘ডক্টর ফ্লয়েড? আমি অ্যাসোসিয়েটেড নিউজের জিম ফ্রস্টার। আপনি কি এ ফ্লাইট নিয়ে দু-চার কথা বলতে পারবেন আমাদের সাথে?’
‘আই অ্যাম ভেরি স্যরি-একটা কথাও বলতে পারব না।’
‘কিন্তু আপনি ঠিকই আজ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছেন। এবার এক পরিচিত স্বর কথা বলে ওঠে।
‘ওহ-হ্যালো, মাইক। তুমি বেচারা শুধু শুধু আরামের বিছানা ছেড়ে এসেছ। অবশ্যই, কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’
‘আপনি অন্তত এটা বলুন, চাঁদে কি কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়ছে?’ এক টিভি রিপোর্টার আশ্চর্য দক্ষতায় তার পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে তাকে ঠিকই নিজের ছোট্ট টিভি ক্যামেরার ফ্রেমে ধরে রাখতে রাখতে বলে চলেছে।
‘স্যরি।’ মাথা নাড়তে নাড়তে ডক্টর ফ্লয়েড বলে।
‘রোগ নির্মূলের ব্যাপারে কী করছেন আপনারা?’ আরেক রিপোর্টার আবার বা হাত ঢোকায়, ‘কদ্দিন লাগবে সেরে উঠতে?’