অন্যদের বেশিরভাগই এত বেশি ভয় পেয়েছে যে বাহতের মতো চেয়ে আছে মাথাটার দিকে। কোনো কোনোটা ধীরে পিছু হটছে। চন্দ্র-দর্শীর এরচেয়ে বেশি উৎসাহের দরকার নেই। মাথার উপর বিকৃত জিনিসটা ধরে রেখেই সে ক্ষীণস্রোতা খালটা পেরুতে শুরু করে। একপল দ্বিধা করে পিছু নেয় সঙ্গীরাও।
দূরপ্রান্তে পৌঁছার পরও এক কানওয়ালা নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইল। হয় সে অতি সাহসী, নয়তো নিতান্তই নির্বোধ। সম্ভবত বুঝতেই পারেনি এ অসম্ভব কী করে সম্ভব হয়! বীর হোক আর ভীতু, শেষে কোনোটাই কাজ দেয় না। কারণ এবার অপ্রতিরোধ্য মৃত্যু নেমে এসেছে তার মাথায়।
ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে অন্যেরা আশপাশের ঝোপে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু একসময় তারা ঠিকই ফিরে আসবে, ঠিকই ভুলে যাবে গোত্রপতিকে।
কয়েক পল চন্দ্র-দর্শী তার নিজের নতুন শিকারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক চোখে দেখে মরা চিতাবাঘটারও হত্যার ক্ষমতা আছে।
আজ সে জগদীশ্বর হলেও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী করতে হবে এরপর।
কিন্তু সে হয়তো কিছু না কিছু করার কথা ভেবে রেখেছে।
অধ্যায় ৬. মানুষের অরুণোদয়
নতুন এক প্রাণী জন্মেছে গ্রহে। আফ্রিকার উৎসভূমি থেকে উঠে এসে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে ছড়িয়ে পড়াটা এত মন্থর গতির যে সাগর আর ভূমিতে বিচরণশীল প্রাণীর উপরে একটা ভালো আদমশুমারীতে হারটাকে গোনা গুনতিতেই ধরা হবে না। এখনো তেমন জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না যার উপর ভিত্তি করে বলা যায় এরা উন্নয়ন করবে। বাঁচবে যে তাই জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এ বসুধার বুকে অগুনতি দানব প্রাণী ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। তাদের পাল্লা আজো একবার এদিকে, আরেকবার সেদিকে হেলে যায়।
স্ফটিকগুলো আফ্রিকায় বর্ষিত হওয়ার লাখো বছরের মধ্যে বনমানুষেরা কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু তারা বদলে যাচ্ছে। তারা এমন কিছু দক্ষতা অর্জন করেছে যা আর কোনো প্রাণীর নেই। হাড়ের তৈরি লাঠিগুলো বাড়িয়ে তুলেছে সম্পদ, বাড়িয়ে চলেছে তাদের শক্তি। আজ আর প্রতিযোগী খাদকদের সামনে তারা অসহায় নয়। ছোটখাট মাংশাসীগুলোকে নিজেরাই তাড়িয়ে বেড়াতে পারে; বড়গুলোর উৎসাহে বরফ ঢেলে দিতে পারে, মাঝে মাঝে করে লড়াই।
তাদের বিকট দর্শন দন্তসারি ছোট হতে থাকে; আজ আর সেসব জরুরী নয়। তীক্ষ্ণ কোণার পাথর দিয়ে শিকড়বাকড় খুঁড়ে নেয়া যায়, কাটা যায় গোশত আর আঁশ। এগুলোই বড় দাঁতের জায়গা দখল করে কালক্রমে। বুনোরা আর দাঁত হারালে বা দাঁতের সমস্যায় পড়লে উপোস দেয় না। এসব সরলতম ভোতা হাতিয়ার মানিয়ে নিতেই তাদের পেরিয়ে যায় কত শতাব্দী! শক্তিশালী জান্তব চোয়াল নিচু আর ছোট হয়ে আসে। গালের হাড় আর বেরিয়ে থাকে না, তাই মুখ আরো স্পষ্ট, কোমল, জটিল আওয়াজ তুলতে পারে নির্বিঘ্নে। ভাষা আজো সুদূর পরাহত; লাখো শতাব্দী পেছনে পড়ে আছে-কিন্তু এর দিকে প্রথম কদম ফেলা হয়ে গেছে।
এবার ভুবন বদলে যেতে লাগল। দুনিয়ার সর্বত্র করাল ছোবল হেনে ফিরে গেল হিমযুগ। এর চার চারটা জোয়ার দু-লাখ বছর করে সময় নিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে গেল পুরো বিশ্বটাকে। ভাটার সময়টুকু বাদ দিয়ে হিমবাহের বহর নির্দয়ভাবে হত্যা করল কত অপরিণত প্রাণীকে! চারদিকে সেসব প্রাণীর চিহ্ন। তারা পারেনি মানিয়ে নিতে।
কুম্ভকর্ণের তামসিক নিদ্রা শেষ হলে বনমানুষসহ গ্রহের প্রথমদিকের জীবনগুলো টিকে যায়। কেউ বংশধর ছেড়ে যায় পৃথিবীর বুকে, তারা হারিয়ে না গেলেও বদলে গেছে অনেকটা। এবার হাতিয়ারের কারিগরেরা হাতিয়ারের প্রয়োজনেই বদলে গেছে।
হাড়ি আর পাথরের ব্যবহারের জন্য তাদের হাত নিয়েছে নতুন রূপ, যেটা প্রাণীরাজ্যের কোথাও পাওয়া যাবে না। এ হাতই আবার নতুন, জটিল হাতিয়ার গড়ার উপযোগী হয়ে ওঠে, সেসব নতুনতর যন্ত্রপাতির প্রয়োজনে বদলে যায় তাদের মস্তিষ্ক, নব রূপলাভ করে বাহ্যিক অঙ্গগুলো। এ এক দ্রুতিময়, বাড়ন্ত প্রক্রিয়া; এর শেষ পরিণতিকেই ডাকা হয় মানব নামে।
প্রথম সত্যিকারের মানব যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করত তা তার পূর্বপুরুষের ব্যবহার করা জিনিসের চেয়ে খুব একটা ব্যতিক্রমী কিছু নয়; কিন্তু সে সেগুলোকে অনেক সহজে অনেক বেশি কাজে ব্যবহার করতে শেখে। সেসব যন্ত্রপাতিও শতাব্দীর অতলে কী করে যেন হারিয়ে যায় সর্বকালের সবচে জরুরী ব্যাপারটার উদ্ভবের আগ দিয়ে। একে ধরাও যায় না, যায় না ছোঁয়া। কথা বলতে শিখতেই সে সময়ের উপর প্রথম বিজয়মাল্যটা ছিনিয়ে আনে নিষ্ঠুরতার সাথে। এবার জ্ঞানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পরিবাহিত করে চলে সহজেই। আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতার পুরোটাই চলে আসে পরের প্রজন্মের হাতের মুঠোয়।
জন্তু জানোয়ারের আছে শুধু বর্তমান, কিন্তু মানুষ এবার অতীতসমৃদ্ধ প্রাণী, তার আছে স্বপ্নেছাওয়া ভবিষ্যৎ।
এবার সে জোরেসোরে প্রকৃতিকে বেঁধে ফেলতে চায় অগ্নিদেবের বাহুডোরে। সে আগুনের সাথে সাথে আবিষ্কার করেছে প্রযুক্তির স্বর্ণদুয়ার, নিজের জান্তব অতীতকে ফেলে দিয়েছে যোজন যোজন পেছনে।
প্রস্তর হার মেনে যায় তাম্রযুগের কাছে, তামা মাথা নোয়ায় লৌহ শৃঙ্খলের সামনে। শিকারের শেষ পরিণতি হিসেবে জন্ম নেয় কৃষি। গোত্রগুলো একত্র হয় গ্রামে, গ্রামের শেষ পরিণতি শহর। কথা চিরস্থায়ী রূপ নেয়; অবদান রাখে লম্বা পাথর, কাদার ফলক আর প্যাপিরাস। আজকাল সে আবিষ্কার করেছে দর্শন শাস্ত্র আর ধর্ম। এবার বসত করা শুরু করেছে আকাশে, পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি, আজো জয় করতে পারেনি দেবতাদের।