নিজের লেজটা অতি আত্মবিশ্বাসে এদিকসেদিক নাড়াতে নাড়াতে চিতাবাঘটা নিজের লোভনীয় খাদ্যের খোঁজে একেবারে ভিতরে প্রবেশ করে বসেছে। খোলা প্রান্তরে শিকারের মুখোমুখি হলে কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু এখন একদল বনমানুষ ফাঁদে পড়ে গেছে, ধ্বংসের ভয়ই তাদের অসম্ভব কাজের পথ বাৎলে দেয়। প্রথমবারের মতো তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার সুযোগ পেয়েছে।
প্রথমে মাথায় আঘাত পেয়ে চিতাটা বুঝতে পারে কোথাও বড় ধরনের গড়বড় আছে। সেটা যে কোথায় তা খুঁজে পায় না। নিজের নখর সামনে বাড়িয়ে দিয়ে গেঁথে ফেলে নরম মাংসে, একই সাথে আরো ব্যথা টের পায়। পেটের দিকে বেশ তীক্ষ্ণ, কেটে ফেলার মতো শক্তিশালী আঘাতের স্বাদ টের পায় একবার, দুবার, এমনকি তৃতীয়বারও। একপাক ঘুরে যায় হিংস্র জন্তুটা, চারপাশের নৃত্যরত ভয় পাওয়া প্রাণীগুলোকে প্রতিরোধ করতে চায়।
এবারো আরেক কষ্ট টের পায় সেটা। কেউ যেন নাকটা একদম কেটে ফেলেছে। ওর সাদা দাঁতগুলো ঝিকিয়ে ওঠে, বসে যায় সামনের অন্টিলোপ হাড়গোড়ের উপর। এবার অবিশ্বাস্যভাবেই কাটা পড়ে তার লেজটা।
চারদিকে পাক খাচ্ছে জটা। গুহা দেয়ালের গায়ে অন্ধভাবেই আঘাতের পর আঘাত করছে। এতক্ষণ যাই করে থাক না কেন, আঘাত বর্ষণ থেকে একটুও বিরত হয়নি বনমানুষেরা। ওদের হাতে নিষ্ঠুর সব যন্ত্র, হাত অপরিণত হলেই বা কী এসে যায়, শক্তি আছে অপরিমেয়। এদিকে চিতার নাক ব্যথা চূড়ান্তে পৌঁছেছে, আতঙ্কে পাগল হওয়ার দশা। অবিসংবাদিত শিকারীই এবার পরিণত হয়েছে অসহায় শিকারে, সব চিন্তা বাদ দিয়ে পিছু হটার ভাবনায় সে এখন দিশেহারা।
এবার বাঘ দ্বিতীয় ভুলটা করে বসে, ব্যথা-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কোথায় আছে তাই ভুলে বসে। নয়তো চোখদুটোও গেছে নষ্ট হয়ে। ব্যাপার যাই হোক না কেন, বজ্রের মতো ছিটকে বেরোয় গুহা থেকে। খোলা বাতাসে পড়তে পড়তে বিকট গর্জনও করে চিতাটা। অনেক যুগ পরে যেন পতনের এক ভারি আওয়াজ উঠে এলো। প্রাণীটা পাহাড়ের অর্ধেক পেরিয়ে নিচে পড়ে গেছে। পরে শুধু ছোটখাট পাথরের গড়িয়ে পড়ার শব্দই শোনা যায়। পাথরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আঁধার রাতের পথে।
আনন্দের আতিশয্যে অনেকক্ষণ ধরে চন্দ্র-দর্শী নেচেকুদে বেড়ায় গুহামুখে। অকস্মাৎ যেন টের পায়, আর সে শিকার নয়, নিজেই শিকারী।
গুহায় ফিরে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো বেঘোরে ঘুমায় অরণ্যচারী প্রাচীন মানব।
.
তারা সকালে পাহাড়ের পাদদেশে দেখতে পায় চিতার শরীরটাকে। সবাই জানে, এ এক মৃত শরীর-আর কিছু নয়। তবু বিকৃত দানবটার আশপাশে সহজে কেউ ঘেঁষতে চায় না। কিন্তু এবার ওরা এগিয়ে এসেছে হাড়ের ঘুরি আর আঁচড় কাটার হাতিয়ার নিয়ে।
কাজটা আসলেই কঠিন। সেদিন আর বনমানুষের দল চষে বেড়ায়নি পাহাড়ের পাদদেশ। প্রথমবারের মতো।
অধ্যায় ৫. ভোরের প্রথম মোকাবিলা
ভোরের প্রথম মৃদু আলোয় দলকে পানির দিকে ঠেলে দিয়েই চন্দ্র-দর্শী হঠাৎ করে থেমে গেল পথের উপর। কিছু একটা নেই। কী যে নেই, বোঝা যাচ্ছে না-কিন্তু কিছু একটা নেই। এ নিয়ে চিন্তা ক্ষয়ের কোনো কারণ দেখে না সে, কারণ সকাল থেকে তার মাথায় চক্কর দিচ্ছে অন্য ধান্ধা।
বিজলীর মতো, মেঘের কালো দলের মতো, চাঁদের সরু আর পেটমোটা হওয়ার মতো সেই বিশাল মনোলিথটা উধাও হয়ে গেছে। যেভাবে এসেছিল, চলে গেছে সেভাবেই। একবার আঁধার অতীতে চলে যাওয়ায় আর কখনোই চিন্তাটা জ্বালাতন করবে না চন্দ্র-দর্শীর মনকে।
সে কোনোকালেই জানবে না কী হারিয়ে গেল চিরতরে। কী করে দিয়ে গেল ওর পুরো জগৎটায়। চন্দ্র-দর্শীর সাথীরা থমকে দাঁড়ায়নি। সকালের রহস্যময় কুয়াশায় তারা শুধু ঘিরে ধরেছে দলপতিকে, কেন দাঁড়িয়ে আছে ও এখানে?
নালাটার নিজেদের দিকের প্রান্তে নিজেদের ত্রাসহীন এলাকায় দাঁড়িয়ে অন্যেরা চন্দ্র-দর্শী আর তার দলের দশ বারোজন পুরুষের দেখা পায়। যেন প্রথম আলোয় চলন্ত কোনো বহর। সাথে সাথেই নিজেদের প্রাত্যহিক চ্যালেঞ্জ শুরু করে দেয়। এই প্রথম সেপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না।
ধীরে সুস্থে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সবচে বড় কথা, নিরবে-চন্দ্র-দর্শী আর ওর দল নদীর অন্যধারের নিচু টিলাটায় গিয়ে ওঠে। ওদের এসব কাণ্ডকারখানা দেখে অন্যেরা একদম নিশুপ হয়ে গেল। বাহাদুরির বদলে হঠাৎ আসা ভয় ওদের জড়সড় করে ফেলেছে। ওরা হালকা বুঝতে পারে যে কিছু একটা ঘটছে, কী যে ঘটছে সেটা বুঝতে পারে না। এবারের মুখোমুখি হওয়াটা আর সব বারের চেয়ে ভিন্নতর। চন্দ্র-দর্শীর দলের হাড়ি-লাঠি আর চাকু-ছুরি ওদের মোটেও ভয় পাওয়ায়নি, কারণ উদ্দেশ্যের এক কোণাও অন্যদের উপলব্ধিতে ঠাই পায়নি। অন্যরা শুধু বুঝতে পেরেছে যে তাদের শত্রুদলের নড়াচড়ায় ভিন্ন কিছু বোঝা যায়।
পানির প্রান্তে পার্টিটা শেষ হতেই অন্যদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। নেতৃত্ব দিচ্ছে এক কানওয়ালা, তারা আবার আধাআধি আত্নবিশ্বাস ফিরে পেতে থাকে। এই বিশ্বাসটা তুঙ্গে থাকে মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরই লা জওয়াব হয়ে যায় তারা একটা দৃশ্য দেখে।
চন্দ্র-দর্শী নিজের হাতটাকে অনেক অনেক উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করে। দেখিয়ে দিচ্ছে দলের লম্বা লোমে আবৃত শরীরগুলোর পেছনে এতক্ষণ লুকিয়ে রাখা বিশেষ একটা গর্বের জিনিসকে। ও একটা ডাল ধরে রেখেছে, সেটার উপর চিতার রক্তাক্ত মাথা। একটা কাঠি ঢুকিয়ে মুখটাকেও হাঁ করিয়েছে ওরা। সামনের দিকের লম্বা দন্তগুলো ঝিকিয়ে উঠেছে সূর্যোদয়ের আলোর স্রোতে।