কিন্তু কোনো ইউটোপিয়াই[৭] নিখুঁত নয়। এ স্বর্গরাজ্যেরও দু-ত্রুটি ছিল। প্রথমটা হলো খোঁজাখুঁজিতে মত্ত চিতা। চিতাটার বনমানুষ-পিপাসা আরো বেড়েছে ওদের শরীর তাগড়া হওয়ার সাথে সাথে। অন্য ত্রুটিটা হল খালের ওপারের গোত্র। কীভাবে যেন ওরা আজো টিকে আছে ধুঁকে ধুঁকে। এখনো গোঁয়ার গোবিন্দের মতো খেয়ে মরতে নারাজ।
হঠাৎ করেই চিতা সমস্যার সমাধান হাজির হয়ে গেল। একটা বড়সড়-বলা চলে প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চন্দ্র-দর্শীর দল। প্রথমবার ধারণাটা মনে আসার সাথে সাথে সে বেশ আনন্দের সাথে উদ্বাহু নৃত্য করেছিল, আর এ অবস্থায় সবদিক বিবেচনায় না নেয়ার দোষও তাকে দেয়া যায় না।
এখনো কালেভদ্রে দুর্দিনের মুখোমুখি হয় বুনোরা। কিন্তু তা আর অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দেয় না। গোধূলী পর্যন্ত একটা শিকারও করতে পারেনি; এখনি চোখে পড়ে গিরিগর্তের ঘরবাড়ি। চন্দ্র-দর্শী নিজের ক্লান্ত আর হতাশ দলটাকে টেনে চলে আশ্রয়ের দিকে। ঠিক এমন সময় চোখে পড়ে যায় প্রকৃতির সবচে দুর্লভ এক উপহার।
একটা পূর্ণবয়স্ক অ্যান্টিলোপ পথের ধারে পড়েছিল। সামনের পা ভাঙা। কিন্তু লড়ার মতো যথেষ্ট শক্তি ছিল বলেই চারধার থেকে ঘিরে ধরা খেকশিয়ালের দল তার তলোয়ারের মতো শিংগুলোর প্রতি যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে চলেছে। রাতের শিকারীদের ধৈর্য ধরার মতো সময় সুযোগ আছে। তারা জানে, শুধু সময় ব্যয় করতে হবে, ব্যস।
কিন্তু শেয়ালের দল প্রতিযোগিতার কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। বনমানুষের দল এগিয়ে এলে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করে। আতঙ্ক জাগানিয়া শিংগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বুনোরাও সাবধানে, ভয়ে ভয়ে চারদিক থেকে একটা বৃত্ত গড়ে চলে। এরপর এগিয়ে যায় পাথরখণ্ড আর লাঠিসোটা নিয়ে।
আক্রমণ খুব বেশি সমন্বিত বা ফলদায়ক হল না। তাই জটা হাল ছেড়ে দিতে দিতে পুরোপুরি রাত নেমে যায়। খেঁকশিয়ালের দল ফিরে পাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। পেটের জ্বালা আর ভয়ে কাবু হয়ে চন্দ্র-দর্শী অকস্মাৎ উপলব্ধি করে যে এসব কষ্ট একেবারে বৃথা যেতে বসেছে। আর এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়।
চন্দ্র-দর্শী এবার নিজেকে এক তীক্ষ্ণবুদ্ধির মেধাবী হিসেবে প্রমাণ করে বসে; আগেও অনেকবার করেছে, পরেও করবে। কল্পনার কত কষ্টের সব ধাপ বেয়ে বেয়ে সে হঠাৎই সুখস্বপ্ন সুধার দেখা পায়। অ্যান্টিলোপের মরদেহটা শুয়ে আছে-তার নিজের নিরাপদতম গুহার ভিতরে! সাথে সাথে শরীরটাকে টানতে শুরু করে গুহামুখের দিকে। বাকীদের উদ্দেশ্য বুঝতে বাকী থাকে না। একটু পরে হাত লাগায় তারাও।
সে কাজটার কষ্ট সম্পর্কে জানলে কখনোই একাজে নামতে না। শুধু তার দারুণ শক্তি আর পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া গোঁড়ামি দিয়ে গুহার ঢাল ধরে উপরদিকে টেনে চলে মরা জিনিসটাকে। হতাশায় কেঁদে দিয়ে কতবার ছেড়েছুঁড়ে দিল পুরস্কারটাকে, কতবার মনের গভীর থেকে আসা ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ক্ষুধার তাড়নায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আবার কখনো বাকীরা সাহায্যের হাত বাড়ায়, কখনো হাত নেয় গুটিয়ে। অবশেষে কাজটা সমাধা হয়, গুহার ঠোঁট পেরিয়ে মরা জানোয়ারটাকে তুলে আনা হয় ভিতরে। সূর্যালোকের প্রথম ক্ষীণ রশ্মি হারিয়ে যাবার পর ভোজ শুরু হল। . কয়েক ঘণ্টা পরে একটু শব্দ শুনে ধড়মড়িয়ে ওঠে চন্দ্র-দর্শী। কেন যেন চারপাশের সাথীদের ঘুমন্ত দেহ ছাড়িয়ে তার কান পেতে দেয় আরো দূরে।
চারপাশের ভারি নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। সারাটা ভুবন যেন ঘুমন্ত। ঠিক মাথার উপর থেকে উপচেপড়া চন্দ্রালোকে গুহার সামনের পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। যে কোনো বিপদের ভাবনাই অবান্তর।
এবার অনেকদূর থেকেই যেন একটা পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ এগিয়ে আসে। চন্দ্র-দর্শী হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, উঁকিঝুঁকি দিল গুহাচত্বরে দাঁড়িয়ে।
নিজের ডানে সে এমন কিছু দেখতে পায় যা বেশ কয়েক মুহূর্ত জুড়ে একেবারে অসাড় করে রাখে তাকে। মাত্র বিশ ফুট নিচেই দুটি ভাটার মতো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। চিতাটা ঐ গন্ধের ইন্দ্রজালে এত বেশি ফেঁসে গেছে যে পেছনে পাথরের উপর ঘুমন্ত নরম দেহগুলোর কথা ভুলেই যায় একদম। এর আগে বাঘটা কখনোই এত উপরে উঠে আসেনি। নিচের দিকের গুহাগুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেই এগিয়ে আসে, যদিও সেসব গিরিগর্তের বাসিন্দাদের ব্যাপারে সে পূর্ণ সজাগ। এবার ও অন্য ক্রীড়ায় মত্ত। রক্তের ক্ষীণধারা জোছনায় ধুয়ে ধুয়ে নেমে আসছে নিচে।
মুহূর্ত কয়েক পরেই উপরের দিকের গুহাবাসীদের চিৎকারে রাতের স্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে যায়। চমক দেয়ার সুযোগ চলে যাওয়ায় চিতাটা হৃষ্টচিত্তে রক্তহিমকরা এক হুংকার দিল। কিন্তু আগপাশ ভালো করে দেখে নেয়নি-কারণ সে জানে ভয়ের কিছু নেই।
রিজের উপর উঠে এসে খোলা সরু জায়গায় এক মুহূর্তের জন্য দম নেয় সে। চারদিকে শোণিতের ঘ্রাণ মোটা মাথাটাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। ভরিয়ে তুলেছে অতি আকাক্ষায়। একবিন্দু দ্বিধা না করে আলতো পায়ে প্রবেশ করে গুহায়।
এটাই চিতার প্রথম ভুল। জোছনা থেকে ভিতরে ঢুকেই ধাঁধায় পড়ে যায় এর রাতের অতি উপযোগী চোখদুটোও। বুনোদলটা চাঁদের আলোর চিত্রপটে বাঘটার অবয়ব দেখতে পায় স্পষ্ট। কিন্তু স্পষ্টভাবে চিতা ওদের দেখতে পায়নি। তারা ভয়ে অস্থির হলেও আজ আর অসহায় নয়।