শূকর দলের নিচু স্তরের বুদ্ধিমত্তার হিসেবেও এ এক বোকাটে কমবয়েসি জানোয়ার। চোখের কোণা দিয়ে চন্দ্র-দর্শীর এগিয়ে আসাটা ঠিকই দেখতে পায় কিন্তু পাত্তা দেয় না মোটেও। আমলে নিয়েছে তখনি যখন আর সময় নেই। আসলেইতো, কেন ছানাটা এই নিতান্ত গোবেচারা প্রাণীগুলোকে গোনায় ধরবে? সে বেখেয়ালে ঘাসের গোড়া চিবিয়েই চলল যে পর্যন্ত চন্দ্র-দর্শীর প্রস্তরখণ্ডটা তার নিষ্প্রভ সচেতনতাকে সচকিত করে না তোলে। হত্যাকাণ্ডটা এত নীরবে, এতো দ্রুত ঘটে গেল যে বাকীরা নিজেদের সামনের ঘাস থেকে মুখও তুলল না।
দলের বাকী অরণ্য-মানবেরাও অবাক চোখে কান্ডকারখানা দেখে। জুটে যায় চন্দ্র-দর্শীর আশপাশে। আরেকজন তুলে নেয় রক্তপাতের আরেক অস্ত্র। আঘাতে আঘাতে বিক্ষত করে দিতে থাকে মরা জটাকে। এরপর বাকীরা কাঠি বা পাথর যাই পাক না কেন, যুগিয়ে নিয়ে নেমে পড়ে সোৎসাহে। থেতলে থেতলে ভর্তা করে ফেলেছে মাংসের তালটাকে।
এবার একটু বিরক্তি আসে। কী লাভ এ অকাজে! দু-চারজন আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছামতো, কেউ আবার ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়েছে অবোধ্য জিনিসটার সামনে।
তারা জানেও না জগতের ভবিষ্যৎ ওদের সিদ্ধান্তের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে উদগ্রভাবে।
অনেক অনেক সময় কেটে যাবার পর কোনো এক পেটের জ্বালায় কাতর বনমানুষী নিজের পাথরের উপর লেগে থাকা সামান্য থেতলে যাওয়া মাংসের দিকে অপলক তাকায়। দু-হাতের পাতায় মেলে ধরা তার অস্ত্রটা।
একটু, সামান্য একটু চেটে দেখে সে মাংসটুকু।
আরো অনেক অনেক সময় লেগে যায় চন্দ্র-দর্শরি। অবাক, বিহ্বল, চিত্রার্পিত বিস্ময়ে সে নিজের ভিতরে উপলব্ধি করে আর কখনো ক্ষুধা তাকে অহর্নিশি জ্বালাবে না।
অধ্যায় ৪. চিতা
ওদের পরিকল্পনার অস্ত্রগুলো অনেক বেশি সরল। তবু এ দিয়েই তারা পুরো পৃথিবীর কর্তৃত্ব নিয়ে নিতে পারে, বনমানুষদের করে তুলতে পারে জগতের অধীশ্বর। পাথর ধরা হাতই সবচে পুরনো অস্ত্র। এ হাত যে কোনো ধাক্কার শক্তিকে আশ্চর্যজনকভাবে ঐশিতা দিতে পারে। অনন্তর এলো হাড়ের ব্যবহার। এগুলো যে কোনো মত্ত দাতাল আর নখরওয়ালা প্রাণীর বিরুদ্ধে চমকপ্রদ কাজ দেয়। এসব অস্ত্রের সাহায্যেই সামনের অসীম-ছোঁয়া চারণভূমির অযুত-নিযুত প্রাণী হয়ে পড়ে তাদের খাদ্য।
অথচ ওদের আরো কিছু থাকা জরুরী। কারণ ওদের দাঁত আর নখ আজো ইঁদুরের চেয়ে বড় কোনোকিছু গ্রহণে সম্মত নয়। কপাল ভালো, এতদিনে হিসেবি প্রকৃতি ঠিক ঠিক অস্ত্রে ওদের সাজিয়ে দিয়েছেন। অস্ত্রের নাম বুদ্ধিমত্তা।
প্রথম প্রথম খুবই ভোতা-টোতা ছুরি-করাতে কাজ চলত। এমন এক চেহারার যন্ত্র এগুলো যা আগামী ত্রিশ লক্ষ বছর এক-আধটু বদলে গিয়ে চালাতে থাকবে কাজ। কোনো কোনো কাজ অ্যান্টিলোপের নিচের চোয়ালের দাঁতাল হাড় দিয়েই চলে। লৌহযুগের আগে তারা আর তেমন বড়সড় ধাপ পেরুবে না। ছোট হরিণের শিং দিয়ে ছুরির কাছাকাছি সুবিধা লুটে নেয়া যায়। ছোটখাট যে কোনো জন্তুর পুরো চোয়াল দিয়ে আঁচড় কাটতো তারা।
পাথুরে লাঠি, দন্তময় করাত, শিঙের ছোরা আর হাড়ের আঁচড়ানিই তাদের প্রয়োজনীয় অসাধারণ আবিষ্কার। অস্তিত্বের জন্য এরচে বেশি কিছুর চাহিদা নেই। শিঘ্রি বনমানবেরা সেসব হাতিয়ারের সবটুকু ক্ষমতার কদর বুঝবে। কিন্তু তাদের জড়ভরত আঙুলগুলোর সেসব ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করতে বা ব্যবহারের ইচ্ছা পোষণ করতেই বহু মাস যাবে পেরিয়ে।
সময় দিলে হয়তো তারা নিজে থেকেই এমন প্রায় অবাস্তব কষ্টসাধ্য ধারণা পেত। প্রাকৃতিক সব জিনিসকে হয়তো ব্যবহার করত কৃত্রিম অস্ত্র হিসেবে। কিন্তু বৈরী পরিবেশ সব সময় চতুর্দিক থেকে মুখ ব্যাদান করে থাকে। আর আজো তাদের সামনে ব্যর্থতার হাজার দুয়ার খোলা।
অরণ্য মানবকুলকে প্রথম সুযোগ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়টা কখনোই আসবে না। ভবিষ্যৎটা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই তাদের হাতে। শুধু হাতের উপর নির্ভরশীল।
.
চাঁদের কলা বদলে বদলে যায়। শিশুরা জন্মে, বেঁচে-বর্তে যায় প্রায়ই। ত্রিশ বছরের অথর্ব, দন্তহীন বুড়োরা যায় মরে।। চিতা ঠিকই রাতে রাতে নিজের খাজনাটুকু কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে চলে। আজো নালার ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে চলে অন্যেরা। আর উন্নয়ন এগিয়ে চলে গোত্রে। একটু একটু করে। এক বছরের ফারাকে চন্দ্র-দর্শী আর ওর উপজাতিটাকে একদম চেনাই যায় না।
নিজের শিক্ষাটুকু ঠিকই নিয়েছে তারা। আজ তারা সামনে পড়া সব টুকটাক যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ক্ষুৎপিপাসার সেই দুঃসহ স্মৃতি বিলীয়মান। কমে আসছে শুকর জাতীয় প্রাণীগুলো। তাতে কী, ছোট হরিণ, অ্যান্টিলোপ আর. জেব্রা আছে সমভূমি জুড়ে। হাজার হাজার। এইসব প্রাণী এবং বাকীরাও পড়েছে মহা ফাঁপড়ে; তারা সবাই শিক্ষার্থী শিকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সময়ের প্রবাহে।
আজ আর তারা প্রাণ-ক্ষুধার টানাপোডনে পড়ে আধমরা নয়। আলসেমির জন্য পড়ে আছে বিস্তর সময়। সময় পড়ে থাকে ভাবনার আদি সূত্রগুলোর জন্য। ভাবনা! ভাবনার জন্য প্রয়োজন শুধু এই সময়টুকুই। নতুন জীবনযাত্রা বেশ উষ্ণভাবেই বরণ করেছে তারা। এ নবজন্মের সাথে কোনোভাবেই মনোলিথের সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। মনোলিথটা আজো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রসবণের পথে। এমনকি কখনো তারা মনোলিথের দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটু থমকে দাঁড়ালেও নিশ্চয়ই মনে করত তাদের এ উন্নতিটা পুরোপুরি নিজস্ব। কারণ এরই মধ্যে জীবনের আর সব রূছু চিত্র মুছে গেছে মন থেকে।