আর কোনো কাজকর্ম নেই। পাঁচ মিনিট পরে সেই সচেতনতা কেটে গেল। এবার আর ক্রিস্টালটাকে অন্ধকারের একটা আকৃতি ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না; আবারো চন্দ্র-দর্শী নিজেকে স্বপ্নভঙ্গের পর খুঁজে পায়। হঠাৎ করেই নিজের অবস্থান বুঝতে পারে, তাড়িয়ে চলে দলকে গুহার দিকে।
যা দেখেছে তার তেমন কোনো সচেতন স্মৃতি ওর মানসপটে নেই। কিন্তু সেই রাতে নিজের গুহার উষ্ণতায় বসে থাকার সময় চারপাশের দুনিয়ার সবটুকু শব্দের সাথে নিজেকে সচেতন করে নেয় সে। চন্দ্র-দর্শী এই প্রথম কোনো নতুন ধরনের অনুভূতির খোঁজ পেয়েছে। পায়ে পায়ে অনুভূতিটার এগিয়ে আসার আওয়াজ শুনতে পায় সে। কোন্ গহীন থেকে উথলে আসে ঈর্ষার অপূর্ণ আর প্রাচীনতম আবেগ। নিজের জীবনের অসফলতার জ্বালা আসে। এর কারণ সম্পর্কে ওর কোনো ধারণাই নেই। এখনো এতে তেমন কিছু যায় আসে না। তার আত্মায় বাসা বেঁধেছে অতৃপ্তি। এভাবেই চন্দ্র-দর্শী প্রথমবারের মতো মানুষ’ এর পথে ছোট্ট কদম ফেলল।
রাতের পর রাত সেই চার তৃপ্ত অরণ্য মানবের দৃশ্য দেখানো হয় যে পর্যন্ত ভিতরে বসে না যায় দৃশ্যগুলো; যে পর্যন্ত ক্ষুধারই মতো রক্তে মিশে না যায়। শুধু নিজের চোখে দেখলে এমন প্রভাব পড়ত না তার উপর। এজন্য প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক চাপ। সেটাও দেয়া হল ভালো করে। চন্দ্র-দর্শীর জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে যা সে কোনোকালে ধরতে পারবে না। ওর একেবারে সরল মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে, প্রতিটি অনুতে এসেছে নতুন মোড়, নতুন বাঁক। ও বেঁচে গেলে সেসব গঠন হয়ে উঠবে চিরঞ্জীব। কারণ তার জিনগুলো এসব বয়ে চলবে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে; শতাব্দী-সহস্রাব্দান্তরে।
এ এক ধীর, জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু ক্রিস্টাল মনোলিথের যথেষ্ট ধৈর্য আছে। সে বা তার আর সব জমজেরা শুধু আধা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েই ক্ষান্ত হয়নি, যেখানে যত প্রাণী পাচ্ছে তার সব নিয়েই করে চলেছে নিরীক্ষা। মরিয়া হয়ে কাজ করছে সাফল্যের আশায়। শত ব্যর্থতায়ও কিছু যায় আসে না-একটা, মাত্র একটা সাফল্য উদ্ভাসিত করে তুলতে পারে চারদিক। বদলে দিতে পারে পৃথিবীর রীতি।
পরের নতুন চাঁদ আসতে আসতে তারা একটা জন্ম আর দুটো মৃত্যু দেখতে পায় চোখের সামনে। একটা মরেছে ক্ষুৎপিপাসায়, অন্যটা রাতে ফেরার সময়। দু খণ্ড পাথরকে ঠুকে দেয়ার কষ্টসাধ্য কাজটা করার সময় সেই বনমানব নিজের মাথাকেই গুঁড়িয়ে দেয়। সাথে সাথে আঁধার ঘনিয়ে আসে মনোলিথ জুড়ে আর গোত্রটাকে জাদুমুক্ত করা হয়। কিন্তু পড়ে যাওয়া বন মানুষটা আর উঠে দাঁড়ায়নি এবং অবশ্যই, সকালে সেখানে কিছুই ছিল না।
পরের রাতে আর কোনো কাজই হয়নি। ক্রিস্টাল তখনো নিজের ভুল বিশ্লেষণে মত্ত। রাত্রি নামার সাথে সাথে ধীরেসুস্থে গোত্রটা ফিরে যায় আশ্রয়ে। এখনো মনোলিথের উপস্থিতি তাদের কাছে অর্থহীন। পরের রাতে জিনিসটা আবারো তাদের জন্য তৈরি হয়ে নেয়।
সেই চার সুখী বনমানুষের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে অসাধারণ সব কাজ। চন্দ্র-দর্শী কাঁপতে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। যেন পুরো মাথাটা ফেটে বেরিয়ে পড়বে। প্রাণপণে চেষ্টা করে চোখদুটো খুঁজে নিতে। কিন্তু সেই নিষ্ঠুর মানসিক যাতনা তার শক্ত থাবায় একবিন্দু ঢিল দেবে না। নিজের সবটুকু চেতনা এর বিরুদ্ধে কাজ করলেও সে শিক্ষাটা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে বাধ্য হল।
চিন্তাটা তার বংশধরদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। পথের চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে কত কত খাদ্য! সময় বদলে গেছে। অতীতের জ্ঞানের বংশানুক্রমিক পরিবহনের এই শুরু। অরণ্যচারী মানবদলকে এর সাথে অবশ্যই মানিয়ে নিতে হবে, নয়তো মিশে যেতে হবে ধূলিকণার সাথে। সেসব বিশালাকার শ্বাপদের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যাদের হাড়গুলোই শুধু চুনাপাথুরে পাহাড়ে পাহাড়ে ফসিল হয়ে আটকে আছে।
চন্দ্র-দর্শী স্থির চোখে চেয়ে থাকে ক্রিস্টাল মনোলিথের দিকে। এদিকে তার মস্তিষ্কের সবটাই খুলে খুলে যায় এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সামনে। কখনো কখনো অনুভব করে অমিত তেজের বিপ্লব। কিন্তু সব সময় তার অনুভূতির প্রায় সবটা জুড়ে বসত করে ক্ষুধার দানবেরা। আর ধীরে ধীরে তার অজান্তেই হাতের মুঠোগুলো ভাজ হয়ে যায়, যায় খুলে। এক অভিনব পথে কাজটা হয়। এমন এক পথে, যেটা জীবনের বাকীটাকে তুলে ধরতে পারে আয়েশী, আলতো হাতে।
.
বুনো শূকরের পিল মাটি শুঁকে বেড়াচ্ছিল, চলছিল ট্রেইল ধরে। হঠাৎ করেই চন্দ্র-দর্শী দাঁড়িয়ে যায়। শূকর আর বনমানুষের দল সব সময়ই একে অন্যকে হেলা করে এসেছে, কারণ এদের মধ্যে মোটেও দ্বন্দ্ব নেই। ভদ্র জন্তু-জানোয়ারের মতো নিজের নিজের পথে চলে, কারণ অপরের সাথে খাবার নিয়ে টানা-হেচড়া নেই।
এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চন্দ্র-দর্শী; ইতস্তত করছে। মন চলে যাচ্ছে সামনে পেছনে, শরীরও যাচ্ছে হেলে। যেন সে এসব ইচ্ছা করে করছে না। তারপর, যেন স্বপ্নের ঘোরেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় মৃত্তিকার কঠিন বুকের দিকে। ঠিক কীসের জন্য এই খোঁজাখুঁজি সেটা সে আদৌ বলতে পারবে না-যদি জবান খুলে যায়, তাও না। পাওয়ার পরই চিনতে পারল সেই আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে।
ইঞ্চি ছয়েক লম্বা তীক্ষাগ্র এক ভারি পাথর সেটা। হাতে ঠিকমতো বসানো যাচ্ছে না, তবু এতেই চলবে। সে জিনিসটাসহ হাত ঘোরায় মাথার উপরে, নিচে। এর বাড়তি ওজনটাও কেমন মাদকতা এনে দেয়। প্রথমবারের মতো ক্ষমতা আর প্রাতিষ্ঠানিকতার শক্তিমান ভূত ভর করে তার উপর। সে সবচে কাছের শূকর ছানাটার দিকে চলতে শুরু করল উৎসাহের সাথে।