অন্যেরা আরো সব অস্বাভাবিক, আপাতত অর্থহীন কাজ করে চলে। কেউ হাত দুটোকে ছড়িয়ে দেয় যথাসম্ভব। একবার দুচোখ খুলে, আরেকবার একটা বন্ধ করে; কেউবা আঙুলের ডগাগুলোকে পরস্পরের সাথে লাগিয়ে নিতে চায়। কাউকে আবার সেসব আলোক কাঠির দিকে চেয়ে থাকতে হয় পলকহীনভাবে। কাঠিগুলো আরো বিভক্ত হয়, আরো ভাগ হয়ে যায়। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর রেখায় বিলীন হয়ে যায়। আবার সবাই শুনতে পায় এক অখণ্ড শব্দের ঢেউ। সেটাও সূক্ষ্ম হয়ে হয়ে হারিয়ে যায় শব্দের[৫] তরঙ্গে।
চন্দ্র-দর্শীর পালা এলে ও ভয় পায় খুব কমই। তার সবচে বড় অনুভবটা সামান্য ব্যথার মতো। যেন আঘাত পেয়েছে কোথাও। পেশীগুলো হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠে, হাত পা এমন কোনো আদেশে নড়ে যা ঠিক তার নয়।
কারণ না জেনেই সে উবু হয়ে তুলে নেয় একটা ছোট্ট পাথর। উপরে উঠেই দেখতে পায় স্বচ্ছ স্ফটিকের কোথাও একটা নতুন গড়ন ফুটে উঠেছে।
সেসব রেখা, নাচতে থাকা চক্র, সব উধাও। তার বদলে ছোট থেকে বড় বৃত্তের দলকে দেখা যায় একের উপর এক পড়ে থাকতে। পানিতে হাত ডোবালে যেমন ঢেউ ওঠে, তেমন। ঠিক মাঝে একটা কালো, ছোট্ট চাকতি।
মস্তিষ্কে আসতে থাকা নিরব আদেশ পালন করে চন্দ্রদর্শী পাথরটাকে মাথার উপরে তোলে, লক্ষ্য বরাবর দেয় ছুঁড়ে। পাথরটা লক্ষ্যের দিকে লক্ষ্যও করেনি।
আবার করো-সেই আদেশ এল। আরেক পাথর পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ছুঁড়ে বেড়ায় আশপাশটা। এবার সশব্দে সেটা আছড়ে পড়ে টার্গেটের উপর। রিনিঝিনি ঝংকার ওঠে সেদিক থেকে। এখনো অনেকদূরে সে, কিন্তু উন্নতি হচ্ছে কাজের ক্ষেত্রে।
চারবারের বেলায় সে কেন্দ্রের চোখটা থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরে পাঠাতে পারে প্রস্তর খণ্ডকে। অপার্থিব বর্ণনাতীত কোনো আনন্দের ঢেউ খেলে গেল এবার তার মনে; প্রায় শারীরিক তৃপ্তির মতো একটা ব্যাপার। এবার একটু ঢিল পড়ে নিয়ন্ত্রণে। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুর তাগাদা অনুভব করছে না চন্দ্র-দর্শী।
একের পর এক গোত্রের সবাইকেই পরীক্ষা করে নেয়া হচ্ছে। কদাচিৎ কেউ সফল হয়, বেশিরভাগই নিজেকে দেয়া কাজটা করতে পারে না ঠিকমতো। আর সবাইকেই উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হচ্ছে, ব্যথা নয়তো আনন্দ।
এবার সেই নব্য প্রস্তরে দেখা দেয় একদেহী নিরাকার আলোর ছটা। যেন চারদিকের আঁধার রাজ্যে এ এক মহামহিম আলোকবর্তিকা। ঘুমের ঘোর কাটার মতো করে তাদের মোহভঙ্গ হল। এবার তারা নিরাপদ আশ্রয়ের পথে চলতে থাকে দুলকি চালে। পেছন ফিরে তাকায়নি। তাকালে অবাক চোখে দেখতে পেত, কোনো এক অদ্ভুত আলো তাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে চলেছে- দেখিয়ে চলেছে অদেখা অচেনা ভবিষ্যতের রাজপথ।
অধ্যায় ৩. শিক্ষালয়
চন্দ্র-দর্শী আর ওর সাথীদের সেসব স্মৃতির কোনোটাই মনে পড়ে না; সেই ক্রিস্টাল, তারপরীক্ষা-নিরীক্ষা আর কাজ করানো-কিছুই না। পরের দিন খাবারের খোঁজে বেরুনোর পরে তারা পাথরের সামনে সামান্য সময়ের জন্যও থমকে দাঁড়ালো না। এখন এটা তাদের স্মৃতির ধূসর, বিবর্ণ, মুছে যাওয়া অংশের অন্তর্গত। ওরা এটাকে খেতে পারবে না, এরও কোনো ক্ষমতা নেই ওদের গলাধঃকরণ করার। সুতরাং কোনো পক্ষ থেকে ক্ষুধা জনিত-সম্পর্ক না থাকায় এর কোনো গুরুত্বই নেই।
পাতলা নদীটার ওপারে সেই অন্যেরা নিজেদের নিষ্ফল আক্রোশ ঢেলে যাচ্ছে। তাদের নেতা এক কানওয়ালা। বয়েস আর আকার প্রকারে চন্দ্র-দর্শীর মতোই। শুধু বেচারার হাল-হকিকত আরো খারাপ। নিজের এলাকায় একটু নেচেকুদে বেড়ায়, রক্তহিমকরা চেঁচামেচির চেষ্টা চালায়। নিজের সাহসকে আরেকটু শক্তি আর অন্যদলকে ভড়কে দেবার উদ্দেশ্যে ক্রমাগত ঝাঁকিয়ে যায় দুই বাহু। আজ ঝরা পানির প্রবাহ কোথাও কোথাও ফুটখানেক গভীর। কিন্তু এক কানওয়ালা টা এর মাঝেই দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আরো বেশি রেগে উঠছে, উঠছে আরো তেতে। ধীরেসুস্থে সে প্রায় নিথর হয়ে আসে। তারপর পিছিয়ে গিয়ে সাথীদের সাথে যোগ দেয় জলপানে।
এটুকু ছাড়া প্রাত্যহিক নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই। সেদিনের মতো খোঁজাখুঁজি শেষ। আরো একটা দিনের চলনসই পুষ্টি জুটে গেল। কেউ মারাও পড়েনি।
সে রাতেও স্ফটিক স্বচ্ছ গড়নটা অধীর অপেক্ষায় রত। চারপাশে সেই আলো আর শব্দের ইন্দ্রজাল। এবারের কাজটা আরো নিখুঁত। ভিন্নতর।
বেশ কয়েকটা বনমানুষকে সে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে। যেন সবচে সম্ভাবনাময় পাণিগুলো নিয়েই এর যত উদ্বেগ। চন্দ্র-দর্শী তাদেরই একজন। আবারো সে মস্তিষ্কের অব্যবহৃত অংশগুলোয় অচিন প্রবাহ অনুভব করে। এবার সে দেখতে লাগল দারুণ সব দৃশ্য।
দৃশ্যেরা হয়তো ক্রিস্টাল মনোলিথটার ভিতরেই আছে, নয়তো তার নিজের মনের গহীনে। কে জানে? আসল কথা হল, চন্দ্র-দর্শীর চোখে সেগুলো একেবারে বাস্তব। আবারো তার সহজাত সব প্রবৃত্তি দৌড়ে পালায় নিজের কাছ থেকে।
ও একটা দারুণ শান্তিতে থাকা পারিবারিক দল দেখতে পাচ্ছে। ওর চেতনার সেই চিরচেনাদের থেকে আপাতত একটা মাত্র পার্থক্য ধরা পড়ে। ভোজবাজির মতো উদয় হওয়া সেই পরিবারের একজন পুরুষ, এক নারী ও দুই শিশু আছে। তারা শান্তভাবে আয়েশী ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে। মোটাসোটা, চর্বিজমা, চকচকে দেহ তাদের। এটা জীবনের সেই ধারা যা চন্দ্র-দর্শীর মনশ্চক্ষুতে কোনোকালে ধরা। দেয়নি। অচেতনভাবেই নিজের শিরদাঁড়ায় ও দৃষ্টি দেয়-এই প্রাণীগুলোর মেরুদন্ড আর বুকের পাঁজর চর্বিতে ঢাকা। সারাক্ষণ তারা অলসভাবে বসে থাকে। কত সহজেই নিজের গুহার চারপাশে রাজত্ব করে চলে! সারা দুনিয়ার সবটুকু শান্তি ভর করেছে তাদের উপর। এক আধবার পুরুষ প্রাণীটা কেমন অপার তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলছে।