দিবসের শেষ আলোয় দলটা আগের পানি-শিকারীদের খোঁজে ইতিউতি তাকাতে তাকাতে তড়িঘড়ি করে পানিতে গলা ভিজিয়ে নিয়ে নিজেদের গুহাপথে ফিরে যেতে শুরু করে। কিম্ভুত শব্দটা শুরুর সময় ওরা নতুন পাথর থেকে শত কদম দূরেই ছিল।
স্পষ্ট শোনা যায়। বজ্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় ওরা। যেন অসাড়ত্ব সারা শরীরকে দখল করে নিয়েছে। যার যার পথেই চোয়াল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা সাধারণ, উন্মাদনাময় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিস্টাল থেকে। এর জাদুর আওতায় পড়া সবাইকে করে তুলছে সম্মোহিত। প্রথমবারের মতো, এবং শেষবারের মতো, তিন মিলিয়ন বছরের জন্য-আফ্রিকার কালো বুকে ঢাকের মৃদুমন্দ বজ্রনিনাদ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে।
কাঁপন আস্তে ধীরে বাড়তেই থাকে, আরো তালে তালে, আরো তালে তালে। এবার অরণ্য মানবেরা সামনে চলতে শুরু করেছে। যেন নিশিতে পাওয়া মানুষ। সামনে•সেই তরঙ্গায়িত শব্দের উৎস। মাঝেমধ্যে এক-আধটু নাচের মোহনীয় ধীরলয়ের ভঙ্গিমা নেয় পদক্ষেপগুলো। তাদের প্রতিটা রক্তকণা উল্লসিত হয়ে উঠেছে। সাড়া দিয়ে চলেছে বহু জনম পরের উত্তেজনার পথে। পুরোপুরি কাছে যাবার পরই সবাই ঘিরে ধরে মনোলিথটাকে। দিবসের সবটুকু ক্লান্তি ওরা ভুলে বসেছে; ভুলে বসেছে আসন্ন গোধূলীর ভয়াল চেহারা আর ক্ষুৎপিপাসার জান্তব জ্বালার কথা।
ঢাকের শব্দ আর রাতের অমানিশা আরো আরো বেড়ে যায়, হয় দ্রুততর। ছায়াগুলো দিগন্ত ছোঁয়া শুরু করলে, সবটুকু সূর্যালোক শোষিত হলে সেই স্ফটিক ছড়াতে শুরু করে আলোর ছটা।
প্রথমে স্বচ্ছতা হারায়। ধারণ করতে থাকে একটু রঙের আবেশ, দুধরঙা ঔজ্জ্বল্য উদ্ভাসিত করে চারদিক। অবোধ্য, অব্যাখ্যাত ভূতেরা দাবড়ে বেড়ায় এর উপরিতল থেকে গভীরে, গভীর থেকে উপরে। হঠাৎ করেই আলো-আঁধারীর রেখায় বিভক্ত হয়ে একদেহী হয়ে ওঠে ওগুলো। পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে বৃত্তাকার ক্রমঘূর্ণায়মান আকার দেয়।
আলোক চক্র আরো আরো দ্রুত ঘুরে চলে। ঢাকের গুড়গুড় আওয়াজ এর সাথে সাথে বেড়ে চলেছে। এখন অকল্পনীয় সম্মোহিত বন মানুষেরা হাঁ করে চেয়ে থাকতে পারে শুধু এই আগুনে খেলার দিকে। নির্নিমেষ। এরমধ্যেই ভুলে বসেছে বংশগত সব অর্জনের কথা, সতর্কতার কথা। বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে জীবনব্যাপী পাওয়া সেসব আত্মরক্ষার শিক্ষা। শুধু তাদের কোনো একজন নয়, সবাই। যেন গুহাগুলো অনেক অনেক দূরে, যেন সেই কষ্টকর বিকাল থেকে তারা বহু যোজন সরে এসেছে। আশপাশের ঝোঁপঝাড় জ্বলজ্বলে চোখের শ্বাপদে গেছে ভরে। রাতের সৃষ্টিরা অনড় বসে আছে, এর পরের ঘটনার জন্য প্রতীক্ষারত।
এবার আলোকমালা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চক্রের ভিতরের রেখাগুলো আলোয় ভাসা দাগে ভাগ হয়ে যায়। অরণ্য মানবের মতো সেগুলোও চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এবার দাগগুলো বিভক্ত হয়ে যায় জোড়ায় জোড়ায়। ফলে উজ্জ্বল জোড়গুলো একে অন্যকে অতিক্রম করে দোলায়িত হতে থাকে। পরস্পরকে ছেদ করার বিন্দু বদলাতে থাকে আস্তে আস্তে। যখন জ্বলজ্বলে খণ্ডগুলো একত্র হয়, আবার যখন হয় আলাদা তখন অসাধারণ ভাসন্ত জ্যামিতিক প্যাটার্নগুলো অস্তিত্বের ভিতর-বাহিরে আলোর ঝলক খেলিয়ে চলে। আর বনের মানুষেরা সেসব বন্দী আলোকোজ্জ্বল জিনিসের কান্ড কারখানা আটকে নেয় নিজের নিজের মনে।
কখনো হয়তো তারা বুঝবে না যে তাদের মনগুলোকে নিরীক্ষা করে নেয়া হয়েছে, এঁকে নেয়া হয়েছে তাদের শরীর, প্রতিক্রিয়ার পল-অনুপল পাকাপাকিভাবে তুলে নেয়া হয়েছে, মাপজোক নেয়া হয়েছে তাদের সবটুকু শক্তি, ক্ষমতা আর সম্পদের। প্রথমেই পুরো উপজাতিকে আধা নত করা হয়। তারা জমাট পাথরের মতো নিথর। এবার স্বচ্ছ স্ফটিকের সবচে কাছের বনমানুষটা অতর্কিতে জীবন ফিরে পায়।
নিজের জায়গা থেকে একটুও নড়েনি। কিন্তু শরীরটা বিমোহিত অবস্থান থেকে সরে আসে। আড়ষ্টভাবে নড়েচড়ে ওঠে, যেন কোনো এক অদৃশ্য খেলুড়ের হাতের পুতুল। অদৃশ্য সুতো যেন চারধারে বিছানো। মাথা একবার এদিক তো আরেকবার ওদিকে নড়ে উঠছে। নিঃশব্দে মুখ খুলেই বন্ধ হয়ে যায়। হাত মুঠো পাকায়, আবার যায় খুলে। এবার শরীর ভাঁজ হয়ে গেল নিচের দিকে। একটা লকলকে ঘাসের ডগা আনল তুলে। অপ্রস্তুত আঙুলগুলো একটা গিট পাকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাকে দেখে মনে হয় একটা ব্যাপারে সে লড়ে চলেছে নিরন্তর। কোনো এক অদেখা নিয়ন্তার হাত থেকে নিজের শরীরটাকে মুক্ত করার প্রাণান্ত প্রয়াস দেখা দেয় তার অভিব্যক্তিতে। বাতাসের জন্য আঁকুপাঁকু করে বেড়ায় ফুসফুস, অপার্থিব আতঙ্ক নগ্ন হয়ে ফুটে ওঠে সারা চোখমুখে। অবর্ণনীয় জান্তবতায় চেষ্টা চালিয়ে যায় আঙুলগুলোকে দিয়ে এমন জটিল কোনো কাজ করাতে যা ইহধামে আর কেউ কোনোকালে করেনি।
নিজের সর্বশক্তি দেবার পরেও পাতাটাকে শুধু দ্বিখণ্ডিত করে বসতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। টুকরোগুলো মাটি ছুঁয়ে দেয়ার সাথে সাথেই নিয়ন্তা শক্তি তাকে ছেড়ে যায়। সে ফিরে যায় অনড় অবস্থায়।
এবার জীবিত হয় আরেক বনমানুষ। সেও একই কাজ করার চেষ্টা করে। বয়সে নবীন হওয়ায় একে দিয়ে কাজ করানো সহজ হচ্ছে। সহজেই তার হাতের ঘাসের ডগাটা বাঁক খায়, একের ভিতর অন্য প্রান্ত প্রবেশ করে। অপেক্ষাকৃত বয়েসীটার ব্যর্থতার উপরেই সে সাফল্যের ঝাণ্ডা ওড়ায়। বসুধার বুকে প্রথমবারের মতো কোনো জটিল বন্ধন সৃষ্টি হল…।