চন্দ্র বা চাঁদ (Moon) : চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ, কোনোভাবেই গ্রহ নয়। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৩৯৯ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। চাঁদের ব্যাস ৩,৪৭৪.২০৬ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, চাঁদের আরতন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বল পৃথিবী পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের এক-ষষ্ঠাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী পৃষ্ঠে কারও ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয় তাহলে চাঁদের পৃষ্ঠে তার ওজন হবে মাত্র ২০ পাউন্ড। বেরিকেন্দ্র নামে পরিচিত একটি সাধারণ অক্ষের সাপেক্ষে পৃথিবী এবং চন্দ্রের ঘূর্ণনের ফলে যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং কেন্দ্রবিমুখী বল সৃষ্টি হয় তা পৃথিবীতে জোয়ারভাটা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির জন্য যে পরিমাণ শক্তি শোষিত হয় তার কারণে বেরিকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে পৃথিবী-চাঁদের যে কক্ষপথ রয়েছে তাতে বিভব শক্তি কমে যায়। এর কারণে এই দুইটি জ্যোতিষ্কের মধ্যে দূরত্ব প্রতি বছর ৩.৮ সেন্টিমিটার করে বেড়ে যায়। যতদিন-না পৃথিবীতে জোয়ারভাটার উপর চাঁদের প্রভাব সম্পূরণ প্রশমিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত চাঁদ দূরে সরে যেতেই থাকবে এবং যেদিন প্রশমনটি ঘটবে সেদিনই চাঁদের কক্ষপথ স্থিরতা পাবে। চাঁদই একমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যাতে মানুষ ভ্রমণ করেছে এবং যার পৃষ্ঠতলে মানুষ অবতরণ করেছে। চাঁদের আবর্তনের পর্যায়কাল এবং তার কক্ষপথের পর্যায়কাল একই হওয়ায় আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ সবসময় দেখতে পাই। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৭ দিন, ৭ ঘন্টা, ৪৩ মিনিট এবং ১১ সেকেন্ড সময় নেয়, কিন্তু সমসাময়িক আবর্তনের ফলে পৃথিবীর পর্যবেক্ষকরা প্রায় ২৯.৫ দিন হিসাবে গণনা করে। একটি ঘণ্টা আবর্তনের পর্যায়কাল অর্ধেক ডিগ্রি দূরত্ব অতিক্রম করে। চাঁদ পৃথিবীকে যে অক্ষরেখায় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে, সে অক্ষরেখায় চাঁদ একদিন বা ২৪ ঘন্টায় ১৩° কোণ অতিক্রম করে। সুতরাং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন, ৭ ঘণ্টা, ৪৩ মিনিট এবং ১১ সেকেন্ড। এই জন্য আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ দেখে থাকি। পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ দেখতে পেয়ে থাকি। চাঁদ আকাশের সবসময় একটি অঞ্চল থাকে তাকে জোডিয়াক বলে। যা ক্রান্তিবৃত্তের প্রায় ৮ ডিগ্রি নীচে এবং গ্রহণরেখা উপরে অবস্থান করে। চাঁদ প্রতি ২ সপ্তাহে একে অতিক্রম করে। পৃথিবী-চন্দ্র সমাহারের অবিরত পরিবর্তন হচ্ছে। চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকে অবস্থিত সমুদ্রের জল তার নীচের মাটি অপেক্ষা বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। এ কারণে চাঁদের দিকে অবস্থিত জল বেশি ফুলে উঠে। আবার পৃথিবীর যে অংশে অবস্থিত জল চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে, সেদিকের সমুদ্রের নীচের মাটি তার উপরের জল অপেক্ষা চাঁদ কর্তৃক অধিক জোরে আকৃষ্ট হয়। কারণ এই মাটি জল অপেক্ষা চাঁদের বেশি নিকটবর্তী। ফলে সেখানকার জল মাটি থেকে দূরে সরে যায়, অর্থাৎ ছাপিয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ফুলে উঠার কাহিনিটিই ঘটে। পৃথিবী যে সময়ের মধ্যে নিজ অক্ষের চারদিকে একবার আবর্তন করে (একদিনে) সে সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে-কোনো অংশ একবার চাঁদের দিকে থাকে এবং একবার চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে। এ কারণে পৃথিবীর যে-কোনো স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়। তবে জোয়ারভাটার জন্য সূর্যের আকর্ষণও অনেকাংশে দায়ী। তবে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের থেকে কম কার্যকর। সূর্য এবং চাঁদ যখন সমসূত্রে পৃথিবীর একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন উভয়ের আকর্ষণে সর্বাপেক্ষা উঁচু জোয়ার হয়, জোয়ারের জল বেশি ছাপিয়ে পড়ে। এই চন্দ্রকে বশে রাখার জন্য মুক্তো (রত্ন Pearl) বা মুন স্টোন (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা ক্ষীরিকা (মূল) বা কমলা (কবচ) বা ২ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।
মঙ্গল (Mars): সৌরজগতের চতুর্থতম গ্রহ হচ্ছে মঙ্গল। মঙ্গল সৌরজগতের শেষ পার্থিব গ্রহ। অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মত ভূত্বক আছে। এর অতি ক্ষীণ বায়ুমণ্ডল রয়েছে, এর ভূত্বকে আছে চাঁদের মতো অসংখ্য খাদ, আর পৃথিবীর মতো আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ। সৌরজগতের সর্ববৃহৎ পাহাড় এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্স। সর্ববৃহৎ গভীর গিরিখাতটিও এই গ্রহে যার নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। মঙ্গলের ঘূর্ণন কাল এবং ঋতু পরিবর্তনও অনেকটা পৃথিবীর মতো। মঙ্গলের ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক এবং ভর পৃথিবীর এক দশমাংশ। এর ঘনত্ব পৃথিবী থেকে কম এবং ভূপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল পৃথিবীর শুষ্ক ভূমির মোট ক্ষেত্রফল থেকে সামান্য কম। মঙ্গল বুধ গ্রহ থেকে বড় হলেও বুধের ঘনত্ব মঙ্গল থেকে বেশি। এর ফলে বুধের পৃষ্ঠতলের অভিকর্ষীয় শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। মঙ্গল দেখতে অনেকটা লাল রঙের কমলার মতো। এর কারণ মঙ্গলের পৃষ্ঠতলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন (৩) অক্সাইডের উপস্থিতি। এই যৌগটিকে সাধারণভাবে রাস্ট বলা হয়। মঙ্গলের পৃষ্ঠ মূলত ব্যাসল্ট দ্বারা গঠিত। মঙ্গলের কিছু কিছু অংশে ব্যাসল্টের চেয়ে সিলিকা জাতীয় পদার্থ বেশি রয়েছে। এই অঞ্চলটি অনেকটা পৃথিবীর অ্যান্ডেসাইট (এক ধরণের আগ্নেয়শিলা) জাতীয় পাথরের মতো। পৃষ্ঠের অনেকটা অংশ সূক্ষ্ণ আয়রন (৩) অক্সাইড যৌগ দ্বারা আবৃত। ধূলিকণা নামে পরিচিত এই যৌগটি অনেকটা ট্যালকম পাউডারের মতো। মঙ্গলের কোনো অভ্যন্তরীণ চৌম্বক ক্ষেত্র নেই। কিন্তু কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে এর ভূত্বকের কিছু অংশ চুম্বকায়িত হয়ে আছে। চুম্বকীয়ভাবে susceptible খনিজ পদার্থের কারণে সৃষ্ট এই চৌম্বকত্বকে প্যালিওম্যাগনেটিজম বলা হয়। এই প্যালিওম্যাগনেটিজমের ধরন অনেকটা পৃথিবীর মহাসাগরীয় গৰ্ভতলে প্রাপ্ত অলটারনেটিং ব্যান্ডের মতো। গ্রহটির কেন্দ্রীয় অংশটির (core) ব্যাসার্ধ প্রায় ১,৪৮০ কিলোমিটার। এই কেন্দ্রভাগ মূলত লোহা দিয়ে গঠিত, অবশ্য লোহার সঙ্গে ১৫ থেকে ১৭% সালফার রয়েছে বলে জানা যায়। এ হিসাবে মঙ্গলের কেন্দ্রভাগ আয়রন সালফাইড দ্বারা গঠিত, যা অনেকাংশে তরল। এই পদার্থগুলোর ঘনত্ব পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত পদার্থের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কেন্দ্রের চারদিক ঘিরে সিলিকেট দ্বারা গঠিত একটি ম্যান্টল আছে, যা গ্রহটির অনেকগুলি শিলাসরণ এবং আগ্নেয় প্রকৃতির কাঠামো তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে ম্যান্টলটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। মঙ্গলের ভূত্বকের গড় পুরুত্ব ৫০ কিলোমিটার। তবে এই পুরুত্ব সর্বোচ্চ ১২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে দেখা যায়। অন্যদিকে পৃথিবীর ভূত্বকের পুরুত্ব গড়ে ৪০ কিলোমিটার। পৃথিবী এবং মঙ্গল এই গ্রহ দুটির আকৃতির অনুপাত বিবেচনায় আনলে পৃথিবীর ভূত্বক মঙ্গলের ভূত্বক থেকে মাত্র তিনগুণ পুরু। মঙ্গলকে বশে রাখার জন্য জ্যোতিষীরা লাল প্রবাল (রত্ন Coral) বা তামা (ধাতু) বা অনন্ত (মূল) বগলা (কবচ) বা ৩ মুখী (রুদ্রাক্ষ) ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।