ভারতে জ্যোতিষচর্চার সূত্রপাত ঋগবেগের কাল থেকে। ক্রান্তদর্শী ঋষিগণ চন্দ্র সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বৈচিত্র্য ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজতে চেয়েছেন। বৈদিক ধর্মকর্ম, যাগযজ্ঞের জন্য কাল নির্ধারণে জ্যোতিষের জ্ঞান থাকা একান্ত অপরিহার্য ছিল। ফলে সূর্য-চন্দ্রের গতি, উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন বিভাগ, সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয়, মাস-পক্ষ-দিন-তিথি নির্ণয়, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, ঋতুবিভাগ প্রভৃতি নির্ণয়ে জ্যোতির্বিদ্যায় জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। জ্যোতিষবিদ্যায় হাত-পা-মুখ দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া নয়।
জ্যোতিষবিদ্যাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয় –(১) গণিত জ্যোতিষ এবং (২) ফলিত জ্যোতিষ। গণিত জ্যোতিষে জ্যোতিষ্ক পরিবারের অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের স্থান, তাদের গতি ও কার্যকলাপ এবং সে বিষয়ে গাণিতিক সূত্রাবলি অর্থাৎ পাটিগণিত, বীজগণিত, পরিমিতি প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। এই শাখার প্রাচীন এবং অন্যতম মনীষীগণ হলেন প্রথম আর্যভট্ট, বরাহমিহির (গ্রন্থ : পঞ্চসিদ্ধান্তিকা), ব্রহ্মগুপ্ত (গ্রন্থ : ব্ৰহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত), ভাস্করাচার্য (গ্রন্থ : সিদ্ধান্তচূড়ামণি) প্রমুখ। অপরদিকে ফলিত জ্যোতিষ হল গ্রহ-নক্ষত্রাদির জ্যোতিষ্ক পদার্থগুলির আবর্তন ও অবস্থান ভেদে মানবজীবনে তথা পৃথিবীর উপর তাদের অনুসন্ধান এবং তার জন্য শুভাশুভ ফল গণনা। ফলিত জ্যোতিষীর প্রাচীন মনীষীগণ হলেন বিষ্ণুগুপ্ত, জীবশর্মা, দেবস্বামী, যবনাচার্য, সত্যাচার্য, সিদ্ধসেন, পৃথু প্রমুখ। ফলিত জ্যোতিষীর গ্রন্থগুলি হল– বৃহৎবিবাহপটল, পল্লববিবাহপটল, বৃহজ্জাতক, লঘুজাতক, বৃহৎসংহিতা ইত্যাদি। বৃহৎবিবাহপটল, পল্লববিবাহপটল গ্রন্থদুটিতে জ্যোতিষবিদ্যা অনুসারে বিবাহের শুভাশুভ কাল বর্ণিত হয়েছে। ফলিত জ্যোতিষকে বরাহমিহির তিনটি শাখায় ভাগ করেছেন। যেমন–
(১) তন্ত্র : জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত। গ্রহগতির আলোচনা গণিতাংশে আছে।
(২) হোরা বা জাতক : কোষ্ঠী সম্পর্কিত বিভাগ। অহোরাত্র’ শব্দের আদি ও অন্ত্যাক্ষর বাদ দিয়ে ‘হোরা’ শব্দ উদ্ভূত হয়েছে। মানুষের ভাগ্য ও কর্মফল, গ্রহের প্রভাব প্রভৃতি আলোচনা হয়েছে।
(৩) সংহিতা : সাধারণ জ্যোতিষ বিষয়ক আলোচনা। যেমন –‘বৃহৎসংহিতা’।
বৃহৎসংহিতা বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক উল্লেখযোগ্য ফলিত জ্যোতিষগ্রন্থ। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়গুলি কি তা দেখা যাক–
(১) রবি প্রভৃতি অষ্টগ্রহের এবং সপ্তর্ষি, ধূমকেতু প্রভৃতির রাশির স্থানান্তর হেতু শুভ ও অশুভ ফল।
(২) নতুন গ্রহের আগমনে তার প্রভাব, বর্ষফল, বৃষ্টিপাত, উল্কাপাত ও পরিবেশের প্রভাব।
(৩) বিভিন্ন রত্ন পরীক্ষার বিধান, স্ত্রী ও পুরুষের লক্ষণ, বৈবাহিক নক্ষত্র ও লগ্ন বিষয়ক আলোচনা।
(৪) পূর্তকর্ম, স্থাপত্য, জাতকশাস্ত্র, অঙ্গবিদ্যা, রাজব্যবহার, বাস্তুবিদ্যা, ভূবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা প্রভৃতি।
(৫) বিভিন্ন গ্রহ বক্র হলে তার খারাপ ফল কেমন হতে পারে তার বিস্তৃত আলোচনা।
(৬) গর্গ, পরাশর, কশ্যপ, ভৃগু, বশিষ্ঠ, বৃহস্পতি, মনু প্রমুখ মনীষীদের নাম ও তাঁদের মতামত আছে। পঞ্জিকাগুলি আসলে সেই জ্যোতিষবিদ্যার ফল।
অতএব জ্যোতিষশাস্ত্র বলতে যা বোঝায় একজন ব্যক্তির বা জাতকের জন্মপত্রিকা অনুশীলনসাপেক্ষে তাঁর চরিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি করা এবং এই কাজে জাতকের জন্ম সময়ের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্রদের অবস্থান পর্যালোচনা করা। জ্যোতিষবিদ্যার এই সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রকৃতপক্ষে সুমেরীয় যুগের অপরিণত জ্যোতিষবিদ্যারই ক্রমবিকাশ। জন্মপত্রিকা থেকে একজন ব্যক্তি বা জাতকের ভাগ্য আগাম বলে দেওয়ার ভাবনা জ্যোতিষীয় পদ্ধতি দৃশ্যমান কোনো ঘটনার উপর তৈরি হয়নি, এর উদ্ভব হয়েছিল জন্মকালে গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে জাতকের তৈরি হওয়া এক অদৃশ্য বন্ধনের অলীক কল্পনা থেকে। বস্তুত জ্যোতিষশাস্ত্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সভ্যতার ধর্মীয় ভাবনাকে ভিত্তি করে। প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায়
প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রকে কোনো-না-কোনো ঈশ্বর বা অতিমানবের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা মনে করতেন, ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন এইসব বস্তু সত্ত্বা পার্থিব জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই বুঝি পৃথিবীর প্রাণীজগত এক অদৃশ্য বন্ধনে মহাজাগতিক গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে আবদ্ধ। অবশ্য এখানে প্রাণীজগত বলতে মানুষের জগত বুঝতে হবে। কেননা মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীদের ভাগ্য-গ্রহ-প্রতিকার নিয়ে বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই।
অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান হল মহাবিশ্ব, মহাবিশ্বের প্রশ্নোত্তর। মহাবিশ্বের অধিকাংশই ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শূন্যস্থান। তাপমাত্রা–২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এর মধ্যে অনেক দূরে দূরে ভেসে আছে গ্যালাক্সি (Galaxy)। চক্রাকার, ডিম্বাকৃতি, এরকম নানা আকৃতির জ্বলন্ত তারা, গ্যসের পুঞ্জ এবং ধুলোর মেঘের সমন্বয়ে গঠিত তারাজগত। এক একটি তারাজগতে ১০০ কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি তারা আছে। আছে ছায়াপথ, এই ছায়াপথে আছে প্রায় ১০ হাজার কোটি তারা। এই ছায়াপথ, অ্যান্ড্রোমিডা, কোলস্যাক, অশ্বমুণ্ড, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র মাজেনিক ক্লাউড ইত্যাদি প্রায় ২৪ টি তারাজগত মিলে তৈরি করেছে একটি মহাতারাজগত। এরকম হাজার হাজার মহারাজগত মহাশূন্যের বিপুল নিকষ কালো অন্ধকারে পুঞ্জে পুঞ্জে অবস্থান করছে। তারাজগতের বিশাল বস্তুপুঞ্জগুলো তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রের প্রচণ্ড অভিকর্ষ বলে সারাক্ষণ পাক খেয়েই চলেছে। যে বস্তু তারাজগতের কেন্দ্রের কাছাকাছি তার গতি দ্রুত এবং যে বস্তু প্রান্তবর্তী তার গতি মন্থর। সূর্য তার গ্রহমণ্ডলী নিয়ে ছায়াপথের কেন্দ্রের চারিদিকে প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। যাই হোক, এবার আমরা দেখে নিতে পারি জ্যোতিষবিদ্যার জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ আর জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহদের চেহারা কেমন। প্রথমেই আসি সূর্যের প্রসঙ্গে। যেটি জ্যোতিষবিদ্যার নক্ষত্র বলা হয় না, বলা হয় গ্রহ।