ভারতের যেমন বরাহ ও মিহিররা একাধারে জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষবিদ ছিলেন, প্রাশ্চাত্যের কিরো কিন্তু আগ মার্কা জ্যোতিষবিদ। জ্যোতিষবিদ হিসাবেই তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বলতে গেলে এই কিরোই বিশ্বজুড়ে জ্যোতিষ ব্যাবসার জন্ম দিয়েছে। কিরো, বেনহ্যাম, সেন্ট জারমেইন, নোয়েন জ্যাকুইন এঁরা সকলেই পাশ্চাত্যের জ্যোতিষবিদ। তবে জানা যায়, কিরো ভারত ও মিশর থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরাট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কিরোকে একটু জানার চেষ্টা করা যাক। কিরোর প্রকৃত নাম কাউন্ট-লুই হ্যামন। কিরোকে নিয়ে এক কৌতূহলোদ্দীপক গল্প চালু আছে। গল্পটি এরকম –কিরো যখন আমেরিকায় পা দিলেন, তখন তাঁকে যাচাই করার জন্য একটি বিখ্যাত আমেরিকান সংবাদপত্র তাঁর সামনে চারটি হাতের ছাপ রাখা হয় এবং বলা হয়– এই চারটি হাতের ছাপ দেখে তাঁদের সম্পর্কে সঠিক বলে দিতে পারলে আমেরিকায় তাঁর বিরাট খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। আর বলতে না পারলে তাঁকে পরের জাহাজে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে। কিরো সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। এরপর একে একে চারটি হাতের ছাপ পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রথম তিনজনের পেশা, জীবনের উন্নতি অবনতি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে বললেন। চতুর্থ হাতের ছাপ দেখে বললেন– “ইনি একজন চিকিৎসক, কিন্তু বিরাট ক্রিমিনাল। তাঁর অপরাধের জন্য ধরা পড়ে জেলে যাবেন। কিন্তু তাঁর ফাঁসির হুকুম হলেও শেষপর্যন্ত ফাঁসি হবে না। জেলখানাতেই তাঁর মৃত্যু হবে।” শেষপর্যন্ত সেই ক্রিমিনাল চিকিৎসকের কী হয়েছিল, তা অবশ্য জানা যায়নি। দ্বিতীয় একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। সেই ঘটনাটি এরকম –একবার এক বিখ্যাত নারী গোয়েন্দা মাতাহারির হাত দেখে কিরো বললেন –“তুমি অবিলম্বে এই পেশা ত্যাগ করো। তা না-হলে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।” মাতাহারি বলেন– “তোমার কথা আমি মেনে নিতে প্রস্তুত কিরো। কিন্তু এইভাবে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আমার কাছে দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই।” একথা সবাই জানেনে গোয়েন্দা, পুলিশ, সেনা সর্বদাই ঝুঁকির চাকরি, যাঁরা প্রাণ বাজি রেখে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেকেরই মৃত্যু হয়। ঝড়ে কাক মরলে গুণিনের নাম তো ফাটবেই। চাইলে যে কেউ এমন গুণিন হতে পারেন।
আরিস্টটল মনে করতেন –“বিশ্ব দুটি ভাগে বিভাজিত। (১) পার্থিব, যেখানে পাপে পরিপূর্ণ এবং (২) গাগনিক বা স্বর্গীয়, যেখানে সবই নিখুঁত ও অপরিবর্তনীয়। বিশ্বের কেন্দ্রে আছে অনড় পৃথিবী, আর তাকে কেন্দ্র করে পূর্ব থেকে পশ্চিম ঘুরে চলেছে ৫৬টি গোলক, যেখানে আছে গাগনিক বস্তুগুলি। সবচেয়ে নীচের গোলকে আছে চাঁদ, এই চাঁদই পাপী পৃথিবী এবং পবিত্র স্বর্গীয় অঞ্চলের সীমারেখাকে নির্দেশ করছে।” অ্যারিস্টটলের এই ধারণাই চার্চের মতবাদ হিসাবে প্রচারিত হত। সাধারণ মানুষও এটাই জেনেছিল। এই মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ করা মানে ধর্মদ্রোহিতার সমতুল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ টলেমি চিন্তাবিদ দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ধারণার উপর ভিত্তি করে ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের এক সম্পূর্ণ ছবি সামনে আনেন। তিনি বলেন –অনড় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সাতটি নিখুঁত গোলক (যথাক্রমে চাঁদ, বুধ, শুক্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি) সুসম বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে এবং অষ্টম গোলকে নক্ষত্রের অবস্থান করছে। বহু পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাস ১৫৪৩ সালে এক গ্রন্থে বললেন –“পৃথিবী নয়, বিশ্বের কেন্দ্রে আছে সূর্য। সূর্যকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে।” ইতালির চিন্তাবিদ জিওনার্দো ব্রুনো কোপারনিকাসের এই সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করতে থাকলেন। এটা প্রচার করার অপরাধে ব্রুনো অপরাধী সাব্যস্ত হলেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে বিচার চলল এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ড আদেশ হল। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ব্রুনোকে দাউদাউ আগুনে পুড়িয়ে মারা হল। সাল ১৬০০। মারা গেলেন জ্যোতির্বিদ, কিন্তু সত্য আজও বেঁচে আছে। সৌরতত্ত্ব আজও সত্যে অটুট। সাল ১৬০৯, জার্মানির জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বললেন– “কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বটি সঠিক।”
সভ্যতার উষাকাল থেকে বহুকাল পর্যন্ত জ্যোতিষবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্দশ বিদ্যার কথা বলা হয়েছে– চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ন্যায়, ধর্মশাস্ত্র এবং পুরাণ। ছয় বেদাঙ্গের মধ্যে জ্যোতিষ অন্যতম। পাণিনীয় শিক্ষায় জ্যোতিষকে বেদপুরুষের দুই চক্ষুরূপে কল্পনা করা হয়েছে –“জ্যোতিষাময়নং চক্ষঃ”। শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন –“যে শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জ্যোতিষ্কসমূহের পরিভ্রমণকাল, তাদের স্বরূপ, সঞ্চার, অবস্থান এবং তৎসম্বন্ধীয় যাবতীয় ঘটনাবলি মানুষের জীবনে তাদের প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে পারি তাই জ্যোতিষ।” বোঝাই যাচ্ছে এ জ্যোতিষের প্রবক্তা ব্রাহ্মণ্যবাদ। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার অছিলায় ‘ভগবান সাজার শ্রেষ্ঠ উপায়। বিস্ময়াভূত মানুষদের কাছে জ্যোতিষের আসন ভগবান শ্রদ্ধার। তাই জ্যোতিষচর্চায় পোপ-পাদরি-ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার।