ভারতে বৈদিক যুগের মাঝামাঝি মায় ব্রাহ্মণ সাহিত্যাদি রচনার যুগ থেকেই জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অগ্রগতি হয়েছিল। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা বলেন– প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে জ্যোতিষীর ভবিষ্যবিচারের কোনো ইঙ্গিত নেই। হস্তরেখা বিচারের প্রাচীনতম আলোেচনা গরুড়পুরাণে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের ‘বৃহৎসংহিতা’, যে গ্রন্থটির রচয়িতা বরাহমিহির। বরাহমিহির ছিলেন শক জাতিভুক্ত। সেসময় আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও রাজপুতানার নিয়ে গঠিত এক বিরাট এলাকা জুড়ে শকস্তান নামের এক রাজ্য ছিল। শকরা ছিল মূলত পূর্ব ইরান থেকে আগত একটি গোত্রগোষ্ঠী।
অন্য এক কাহিনিতে জানা যাচ্ছে তাঁর বাবার নাম আদিত্যদাস, আদিত্যদাস মানে এখানে সূর্যের দাস। বরাহমিহির ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে উজ্জয়নীর নিকটবর্তী গ্রাম কাপ্তিঠে ব্রাহ্মণদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন সূর্য দেবতার উপাসক এবং তিনিই বরাহমিহির জ্যোতিষ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে বরাহমিহির একাধারে জ্যোতির্বিদ এবং জ্যোতিষী। কুসুমপুরা (পাটনা) সফরে যুবক বরাহমিহির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ আর্যভট্টের সাথে দেখা করলেন। তিনি তাকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যাকে আজীবন অনুসরণ হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বিক্রমাদিত্যের এই রত্ন ‘বরাহ’ উপাধি পেলেন। কীভাবে পেলেন তার একটা গল্প প্রচলন আছে। রাজকীয় জ্যোতিষ মিহিরের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজা বিক্রমাদিত্য অশান্ত ছিলেন। তিনি সুসজ্জিত এবং জনাকীর্ণ আদালতের চারপাশে তাঁকিয়ে বললেন, “এটা কি সত্য হতে পারে?” কোনো উত্তর ছিল না। রাজকীয় জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীতে শব্দের বাইরে সবাই হতবাক হয়ে যাওয়ায় নীরবতা ছিল। নীরবতা ভঙ্গ করে এবং নিজেই দুঃখের সঙ্গে রাজকীয় জ্যোতিষ এই ভবিষ্যদ্বাণীটির সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন, “গ্রহগুলির অবস্থানটি ১৮ বছর বয়সে রাজপুত্রের মৃত্যুর পূর্বাভাস দেয়।” যদিও রাজা তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু রানি নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি এবং বলে ওঠেন– “প্রভু আপনাকে এই ভবিষ্যদ্বাণীটি মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে।” যদিও রাজা তাঁর জ্যোতিষী মিহিরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন, তবে তিনি পুত্রকে রক্ষা এবং বাঁচাতে প্রতিটি সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু পূর্বাভাসের দিন, একটি শুয়োর রাজপুত্রকে হত্যা করেছিল। সম্রাটের কাছে এই সংবাদ পৌঁছোলে তিনি মিহিরাকে তাঁর দরবারে ডেকে বললেন, “আমি পরাজিত, তুমি জিতেছিলে, তুমি জিতেছ।” জ্যোতিষী রাজার মতোই দুঃখিত ছিলেন এবং তিনি উত্তর দিলেন– “আমার প্রভু। আমি জিতিনি। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষবিজ্ঞানের জয়!” রাজা বললেন –“এটি যাই হোক না কেন, আমার শ্রদ্ধেয় জ্যোতিষী। এটি আমাকে নিশ্চিত করেছে যে, আপনার বিজ্ঞান সত্য ছাড়া কিছুই নয়। এবং এই বিষয়ে আপনার দক্ষতার জন্য, এখন আমি আপনাকে মাগধ রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার, বরাহর প্রতীক (শুয়োর) দেব। সুতরাং সেই সময় থেকেই মিহির বরাহমিহির নামে পরিচিতি লাভ করে।
অন্য আর-এক কাহিনি থেকে জানা যায় খনার স্বামী মিহির। সেই মিহিরের বাবা বরাহ। খনা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী বিদূষী নারী। কথিত আছে, বিক্রমপুরের রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ তাঁর পুত্রের জন্ম গোষ্ঠী গণনা করে পুত্রের আয়ু এক বছর দেখতে পেয়ে শিশুপুত্র মিহিরকে একটি পাত্র করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌঁছেলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালনপালন করেন এবং খনার সঙ্গে বিয়ে দেন। খনা, বরাহ ও মিহির সকলেই একাধারে জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষবিদ ছিলেন। একদিন শ্বশুর বরাহ ও স্বামী মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে খনা সমস্যার সমাধান বের করে দেন। খনার দেওয়া পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষিজীবীরা উপকৃত হতেন বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসাবে নিযুক্ত করেন। এতে বরাহ ও মিহির প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির খনার জিভ কেটে দেয়, যাতে খনা কোনোদিন ভবিষ্যদ্বাণী তথা পূর্বাভাস দিতে না না পারে। জিভ কাটার ফলে কিছুকাল পরে খনার অকালমৃত্যু হয়। পরে বরাহ ও মিহিরের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে– বরাহমিহির।
ব্রাহ্মণ্য যুগে জ্যোতর্বিদ্যাকে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যা হিসাবে গণ্য করত। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে জ্যোতিষকে বলা হয়েছে ‘নক্ষত্রবিদ্যা’ এবং জ্যোতির্বিদকে ‘নক্ষত্র দর্শক’ বলা হয়েছে। আর্যভট্টই প্রথম ভারতীয় জ্যোতির্বিদ, যিনি পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা বলেন। গ্রিকদের অনেক আগে থেকেই ব্যাবিলনীয়, মিশরীয় এবং ভারতীয়রা ২০০০ বছর ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করে এসেছে। সেই জ্ঞান চর্চা অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের পরিপূর্ণ সদব্যবহার গ্রিক বিজ্ঞানীরা করেছেন। গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কখনোই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ধর্ম এবং ফলিত জ্যোতিষের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেনি।