কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাবগম্ভীর বিষয় হলেও যতটা সম্ভব প্রাঞ্জল ভাষায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সংকলনে যেসব প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিদগ্ধ ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের দাবিতে পাঠকদের কাছে সেগুলি দুই মলাটে করে বন্দি পৌঁছে দিতে পারলাম। এই গ্রন্থটির বিষয়বৈচিত্র্য নিশ্চয় পাঠকদের মন জয় করতে পারবে।
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান
প্ল্যাটফর্মে ধাতুর আংটি বিক্রেতা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে আংটিটি আঙুলে ঢোকানোর। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হবেন নাই-বা কেন! আঙুলগুলিতে তো আর আংটি ঢোকানোর জায়গাই নেই। দশ আঙুলে কুড়িটা রত্নখোচিত আংটির উপর ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি কোথায় ঢুকবে? পোখরাজ, গোমেদ, পান্না, চুনি, প্রবাল– কী নেই সেই দশ আঙুলে! ডাবল ডাবলও আছে। ‘রহিস আদমি’ পেয়ে জ্যোতিষীরা ওর দশ আঙুলে বিশটা আংটি ভজিয়ে দিয়েছে। ওই বিশটা আংটিতেও যে কাজ হয়নি, তা ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি পরার ব্যাকুলতাতেই আন্দাজ করা যায়।
আর-একটা ঘটনা বলি : বছর কুড়ি আগে আকাশবাণীর ‘বিজ্ঞানরসিকের দরবারে’ শিরোনামে অনুষ্ঠান হত। কোনো একদিনের অনুষ্ঠানে কলকাতার স্বনামখ্যাত পাঁচজন জ্যোতিষীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কোষ্ঠী বিচারের জন্য। পাঁচ জ্যোতিষীই জানতেন এই কাজটি করতে শুধুমাত্র তাঁকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও ট্যবলেট বিক্রেতা এক স্বনামধন্য লাল জ্যোতিষী ছাড়া বাকি চারজন জ্যোতিষী আকাশবাণীতে গিয়েছিলেন নিজেকে যথার্থ ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’ প্রমাণ করতে। চারজন জ্যোতিষীকে চারটি ভিন্ন ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছিল একই ব্যক্তির কোষ্ঠী দিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে চারজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে একই ব্যক্তির চারটি কোষ্ঠী জমা নেওয়ার পর দেখা গেল চার ধরনের বিচার। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই। এখানেই শেষ নয় বিস্ময়ের। সেই কোষ্ঠীর জাতক ছিলেন একজন মৃত শিশুর। সেই মৃত শিশুর কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীরা বলেছিলেন যে জাতকের কবে বিয়ে হবে, কবে চাকরি হবে, কবে ফাড়াইত্যাদি ইত্যাদি হাস্যকর কথাবার্তা।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে যে কজন জ্যোতিষীর কাছে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিল–নির্বাচনে জিতে কোন্ দল আসছে? সব জ্যোতিষী একবাক্যে বলেছিল –বিজেপিই বিপুল আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসছে। জ্যোতিষীদের মিথ্যা প্রমাণ করিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আসন নিয়ে ক্ষমতায় তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা চলে এলো। বিশ্বজুড়ে করোনা ‘অতিমারি’-র কোনো পূর্বাভাস একজন জ্যোতিষীও দিতে পারেনি।
এরকম ঘটনার ঝুড়ি ঝুড়ি উল্লেখ করা যায়। তাতে লাভ কিছু নেই। মানুষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে, জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষী যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি জ্যোতিষ আসলে কী? জ্যোতিষ কি শাস্ত্র? নাকি বিজ্ঞান? প্রচুর বিতর্ক, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এ বিষয়ে। তবুও আমি আমার মতো চেষ্টা করি। বোঝার এবং বোঝাবার।
‘জ্যোতির্বিদ্যা’(Astronomy) আর ‘জ্যোতিষবিদ্যা’(Astrology) কি একই বিষয়? না, একই বিষয় নয় তো! যদিও উচ্চারণের দিক থেকে দুটি শব্দ খুবই কাছাকাছি। অর্থ কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। জ্যোতিষবিদ্যা যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জ্যোতিষী এবং জ্যোতির্বিদ্যা যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জ্যোতির্বিদ। জ্যোতিষী হলেন কিরো, ভৃগু, পরাশর, অমুক সম্রাট, তমুক সমুদ্ররা। এঁরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা! অপরদিকে জ্যোতির্বিদ হলেন উইলিয়ম হার্শেল, ভেইনু বাপ্প, মেঘনাদ সাহা, জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকার, আর্যভট্ট, গ্যালিলিও, কোপারনিকাস প্রমুখ। এঁরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন। জ্যোতির্বিদ্যার বিষয় সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ছায়াপুঞ্জ, উল্কা, ধূমকেতু। জ্যোতিষবিদ্যার বিদ্যার বিষয় হাত-পা-মুখ-কপাল গুনে ব্যক্তির ভূত-ভবিষ্যত বলে দেওয়া। জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের চারপাশে পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহরা ঘুরপাক খায়। জ্যোতিষবিদ্যায় পৃথিবীর চারপাশে সূর্য সহ অন্যান্য গ্রহরা ঘুরপাক খায়। পৃথিবী নামে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় উপগ্রহ আছে, জ্যোতিষবিদ্যায় কোনো উপগ্রহ নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় রাহু ও কেতুর কোনো অস্তিত্ব নেই, জ্যোতিষবিদ্যায় রাহু ও কেতুর অস্তিত্ব প্রবল। মানুষের জীবন উলটপালট করে দেওয়ার বিপুল ক্ষমতা রাখে! জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহ বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো ইত্যাদি। জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহরা বালি-পাথর-গ্যাসীয় মহাজাগতিক নিথর বস্তু বিশেষ। জ্যোতিষবিদ্যার গ্রহ সূর্য বা রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু এবং কেতু। জ্যোতিষবিদ্যার গ্রহরা সবাই দেবতা, তাঁদের কোপে মানুষের ‘সব্বোনাশ’ হয়। জ্যোতিষবিদ্যায় গ্রহরত্ন, গ্রহমূল, অষ্টধাতুর ব্যবহার আছে। জ্যোতির্বিদ্যায় এসবের কোনো ব্যবহারই নেই। জ্যোতিষবিদ্যায় মামলা-মোকদ্দমা জিতিয়ে দেওয়া, বিয়ে হওয়া, পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার দাবি করে। জ্যোতির্বিদ্যায় এসবের কোনো চর্চা নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় পদার্থবিদ্যা, গণিত, দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রয়োজন হয়। জ্যোতিষবিদ্যায় কোনো বিদ্যাই লাগে না– লাগে ব্যক্তির দুর্বলতা খুঁজে বের করার ক্ষমতা, কৌশল-চাতুরতা, সম্মোহনী আর রত্ন-মাদুলি-কবচ গছানোর ক্ষমতা। গ্রহ-নক্ষত্র দেখতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগে না, দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়াই বহুদূরে থাকা ভবিষ্যত আর অতীত দেখাই জ্যোতিষীদের কর্মকাণ্ড।