জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চায় মুসলমানদের বেশ সুনাম অদ্যাবধি কাল থেকেই আছে। পেশাগত জীবনযাপনের তাগিদে এবং স্থল ও জলপথে বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের প্রয়োজন হত আকাশের গ্রহ-তারকাদের অবস্থান জানার। মুসলমানদের বিজ্ঞানে অগ্রসরতা এবং সপ্তম শতক হতে পনেরো শতক পর্যন্ত যে সকল মুসলমান বিদূষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায় প্রভূত অবদান রেখেছেন তারা আর যে বিষয়ই নিয়েই পড়ে থাকুন না-কেন, তারা সবাই কিছু-কিছু অবদান রেখেছেন এই জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞানে। তারা গবেষণা করে গেছেন আর লিখেছেন একের পর এক বই।
আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ আত্মনিবেদন করতে শেখে। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গর্ব অনুভব করে, দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনাকে ভুলে থাকতে শেখে। এরা লড়াই জানে না, লড়াই দেখলে ভীত হয়। এমতাবস্থায় অদৃষ্ট বা নিয়তির শরণাপন্ন হয়। জেগে ওঠে জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষীবাবুরা। হাত বড়িয়ে দেয়– একপক্ষে
জ্যোতিষীবাবুর হাত, অপরপক্ষে জাতকের হাত। কী আছে হাতে? রেখা? রেখায় কী আছে? আছে স্বল্প রেখাযুক্ত পরিষ্কার হাত এবং বহু সূক্ষ্ম রেখাযুক্ত হাত। লালচে হাত, গোলাপি হাত, সাদাটে হাত, হলদেটে হাত। আছে চওড়া তালু, বেঁটে ও মোটা আঙুল, কুশ্রী নখ। আছে চৌকো হাত, চৌকো হাতে লম্বা আঙুল, দার্শনিক হাত, শিল্পী হাত, আধ্যাত্মিক হাত। আছে নমনীয় বুড়ো আঙুল, অনমনীয় বুড়ো আঙুল। খুব লম্বা নখ, খুব লম্বা ও সরু নখ, খুব লম্বা নীলচে অথবা মলিন বর্ণের চোখ, ছোটো নীলচে নখ, ছোটো গোলাকার নখ, ছোটো অথচ নখের তলার দিকটা চ্যাপটা, ছোটো অথচ নখের তলার দিকে সাদা। চাঁদ, শরীরের ভিতর গভীরভাবে চেপে বসা চ্যাপটা নখ, নখে সাদা দাগ ইত্যাদি।
এমন কোনো মানুষ নেই যাঁর হাতে ভাঁজ বা কোঁচকানো দাগ বা রেখা নেই। কারোর ঘন দাগ, কারোর-বা অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা। এইসব দাগগুলি আবার বিভিন্ন নামে পরিচয় আছে। যেমন–আয়ুরেখা, হৃদয়রেখা, ভাগ্যরেখা, রবিরেখা, বিবাহরেখা ইত্যাদি। এছাড়া হাতের উঁচুনীচু অংশগুলিতে আছে গ্রহস্থল– মানে কোথায় রবি অবস্থান করছে, কোথায় মঙ্গল অবস্থান করছে, কোথায় রাহু অবস্থান করছে ইত্যাদি। হাতের রং দেখেও জ্যোতিষবাবুরা ভাগ্যগণনা করে থাকেন। আছে তারা চিহ্ন, ক্রশ চিহ্ন, চতুষ্কোণ, যব বা দ্বীপ চিহ্ন, বৃত্ত বা চক্র চিহ্ন, ত্রিশূল, জাল চিহ্ন ইত্যাদি– এইসব চিহ্নগুলিও অনেক ভবিষ্যৎবার্তা দেয় বলে জ্যোতিষবাবুরা নিদান দেন।
মানুষের হাতের তালুতে থাকা যেসব ছাই-ছাতার উপর জ্যোতিষবাবুরা ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন বলে দাবি করেন সেগুলি আসলে কী? মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা হাতের তালু মুঠো করতে পারে। হাতের তালু মুঠো করতে পারার কারণ তালুর এই ভাঁজগুলি। এই ভাঁজগুলি (গভীর রেখা ও সূক্ষ্ম রেখা) প্রাথমিকভাবে মানুষের মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই তৈরি হয়। শিশু মায়ের গর্ভে যখন থাকে তখন তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থায় থাকে। ভ্রূণ অবস্থায় শিশুর চামড়া ও মাংসপেশি সাত/আট সপ্তাহ নাগাদ তৈরি হয়। এই অবস্থায় মাংসপেশিতে জলের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি থাকে। এরপর আস্তে আস্তে যতই মাংসপেশিগুলিতে জলের পরিমাণ কমতে থাকে ততই সংকোচনের ফলে মাংসপেশির উপর টান হয়ে এঁটে থাকা চামড়া ক্রমশ শিথিল হতে থাকে এবং কুঁচকে যেতে থাকে। ফলে হাতের তালুর চামড়ার বিভিন্ন জায়গায় ভাঁজ পড়ে যায়। শিশুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে এই কোঁচকানো চামড়াই দাগ হিসাবে দেখি। এ দাগ ব্যক্তির মৃত্যু পরও থাকে। পেশিতন্তুর সংকোচনে। তৈরি হয় সূক্ষ্মরেখা এবং দুটি পেশি-অংশের সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয় গভীর রেখা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তালুতে চামড়ার নীচের মাংসপেশির সংকোচন প্রসারণের উপর নির্ভর করে হাতের তালুতে ছোটো ছোটো রেখা তৈরি হয়। মানুষের শরীরের যে অংশ সবচেয়ে বেশি ফোল্ড হয় এবং নড়াচড়া হয়, তা হল হাতের তালু, সে কারণে হাতের তালুতেই এত ভাঁজ সৃষ্টি হয়। যদি হাতের তালুর মতো পায়ের তালুও ভাঁজ করার প্রয়োজন হত, তাহলে পায়েও এরকম দাগ আমরা পেতাম। মানুষ ছাড়াও গেরিলা, বাঁদর, শিম্পাঞ্জী গোত্রীয় প্রাণীদের হাতের তালুতে ভাঁজ লক্ষ করা যায়। তবে মানুষের তালুর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। এই রেখা মানুষের কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না, করতে পারে না। নানা কারণে মানুষের হাতের কবজি বা আঙুল কেটে বাদ হয়ে যায়, কিংবা দুর্ঘটনায় দুটো হাতই বাদ চলে যায়– এই যে যাদের হাত বা কবজি বা আঙুল কেটে বাদ হয়ে যায়, তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ কোথায় লেখা থাকে ভেবে দেখব না আমরা! যেমন ধরুন, কোনো ব্যক্তির বুড়ো আঙুলটা যদি না থাকে, তবে তো তার আয়ুরেখাও নেই– আয়ুরেখা নেই মানে, মৃত্যুও নেই। তাই হয় নাকি! জ্যোতিষবিদ্যার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হচ্ছে কিনোর বই। কিয়োর বই আমিও পড়েছি। তবে কলকাতায় ভৃগু প্রণীত জ্যোতিষ শিক্ষার বইও পাওয়া যায়। এই ভৃগু একাধারে জ্যোতিষজ্ঞ, যৌনবিষয়ক লেখক, গোয়েন্দা গল্পকার। এই কিতাব পড়েও অনেকে জ্যোতিষী ফলায় গ্রামেগঞ্জে। যাই হোক, কিরোর বই আপনিও পড়ে দেখতে পারেন। হাতের রেখা কীরকম হলে সেই হাতের মালিক কেমন ভাগ্যের অধিকারী হবেন, সেগুলিই উল্লেখ করা আছে। কিন্তু কার্যকারণ নেই। কোনো সংগতি তথ্য নেই। আশাও করবেন না। কোনো কেনর উত্তর নেই। কারণ হস্তরেখাবিদদের সেই দায় আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। বরং বেশি লাফালাফি করলে মাসলম্যানদের দিয়ে কিমা করে দিতে পারে আপনাকে।