ভারত তথা হিন্দুধর্মের মানুষদের মধ্যেই জ্যোতিষচর্চা খুব বেশি প্রচলন। বস্তুত ব্রাহ্মণ তথা মুনিঋষিরাই ভবিষ্যৎ বলার কাজটা করতেন। ভারতে জ্যোতিষচর্চা মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদের হাত ধরেই এসেছে। একটু নজর রাখলেই জানতে পারবেন জোতিষীদের একটা বড়ো অংশই ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের। একমাত্র ভারতেই ঘরে ঘরে জ্যোতিষী পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে তো জ্যোতিষ-ব্যাবসা কুটিরশিল্প পর্যায়ে চলে গেছে। যিনি হাত-পা দেখেন তিনিও জ্যোতিষী, যিনি হাত-পা দেখান তিনিও জ্যোতিষী। খ্রিস্টানদের মধ্যেও এ বিদ্যা চর্চা অল্পবিস্তর আছে। তবে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে জ্যোতিষচর্চা নিষিদ্ধ। নক্ষত্র ও গ্রহ সংক্রান্ত গণনা অর্থাৎ জ্যোতিষচর্চাকে পূর্ববর্তী মুসলিম পণ্ডিতেরা সামগ্রিকভাবে ‘তানজিম’ বলে অভিহিত করেন। সমগ্র বিশ্ব যেহেতু জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভাবে প্রভাবিত, তাই ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনাসমূহ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করা সম্ভব। এটা বিশ্বাস করা সর্বসম্মতিক্রমে বড়ো ধরনের কুফরি এবং ইব্রাহিম এর জাতির শিরকের মতো শিরক। “যে ব্যক্তি কোনো গণক তথা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে গেল, অতঃপর তাকে (ভাগ্য সম্পর্কে) কিছু জিজ্ঞেস করল অমনি ৪০ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল হবে না।” (সহিহ মুসলিম ২২৩, মুসনাদ আহমাদ ৪/৬৭)। গণক বা জ্যেতিষীদের কথা বিশ্বাস করা আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করার নামান্তর জাদুবিদ্যা শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া কুফরি গোনাহ বা পাপ। যে সাতটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে তার মধ্যে একটি হচ্ছে জাদু। আল্লাহ বলেন, “যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে ধাবিত হোয়য়া না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।” (বনি ইসরাঈল ৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন –“জাদুকর যেখানেই থাকুক সফল হবে না।” (ত্বহা ৬৯)। পক্ষান্তরে কেউ সত্যায়ন না করে, তাদের নিকট অভিজ্ঞতা লাভের জন্য বা পরখ করার জন্য গেলে এটা কুফরের পর্যায়ভূক্ত নয়, কিন্তু ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ ও ইবাদ কবুল হবে না। এ সম্পর্কে রাসুলাল্লাহ বলেছেন– “যারা গণক কিংবা এই জাতীয় লোকের নিকট গিয়ে কোনো কিছু জানতে চাইবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তাদের নামাজ কবুল হবে না।” (মুসলিম শরিফ) জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া, হাত দেখানো তাঁর কথা বিশ্বাস করা একেবারে নাজায়েজ।
ইসলাম মতে, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা বিশ্বাস করা যেমন কুফরি, তেমনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রাশিফলের আশ্রয় নেওয়াও কুফরি। যে ব্যক্তি রাশিফলের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের কথা বিশ্বাস করবে, সে সরাসরি মুশরিক হয়ে যাবে। পত্র-পত্রিকা ও বইপত্রে রাশিফলের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে সেগুলি পাঠ করা শিরক। তবে বিশ্বাস না-করে কেবল মানসিক সান্ত্বনা অর্জনের জন্য পড়লে তাতে শিরক হবে না বটে, কিন্তু সে গোনাহগার হবে। কেন-না শিরকি কোনো কিছু পাঠ করে সান্ত্বনা লাভ করা বৈধ নয়। তা ছাড়া শয়তান কর্তৃক তার মনে উক্ত বিশ্বাস জন্মিয়ে দিতে কতক্ষণ? তখন এ পড়াই তার শিরকের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “গণকের নিকটে কোনো ব্যক্তি গমন করে যদি তাকে কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে ৪০ দিন ও ৪০ রাত পর্যন্ত তাঁর সলাত কবুল হবে না।” (সহিহ মুসলিম)। “যদি কেউ গণকের বা জ্যোতিষীর নিকট গমন করে তাঁর কথায় বিশ্বাস করল, তাহলে সে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ বিষয়কে অবিশ্বাস করল।” (সুনান আবু দাউদ)। হাদিসগুলিতে দৈব জ্ঞানের দাবিদার, গণক, জাদুকর ও তদনুরূপ লোকদের কাছে আসতে এবং তাদেরকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে ও তাদের বক্তব্য সত্য বলে বিশ্বাস করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন ও করা হয়েছে। সুতরাং শাসকবর্গ ও মানুষকে সৎ কাজের আদেশদানের এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ –যাদের হাতে ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই উচিত গণক, দৈব জ্ঞানের দাবিদার ও অনুরূপ পেশাজীবীদের কাছে আসতে লোকদের নিষেধ করা, হাটে-বাজারে ও অন্যত্র যেকোনো ধরনের দৈবজ্ঞান আদানপ্রদান নিষিদ্ধ করা, দৈবজ্ঞ ও তাদের কাছে যারা আসে সবার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। তাদের কথা কোনো কোনো ব্যাপারে সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ার ফলে এবং এক শ্রেণির লোক তাদের কাছে বেশি আনাগোনা করার ফলে তাদের দ্বারা কারও প্রতারিত হওয়া ঠিক নয়। কারণ ওই শ্রেণির লোকেরা মূলত মূর্খ। তাই তাদের দ্বারা প্রতারিত হওয়া অনুচিত। কেননা এতে গুরুতর পাপ, মহাবিপদ ও খারাপ পরিণতি থাকায় এবং যারা এসব কাজে লিপ্ত তারা মিথ্যাবাদী ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক হওয়ায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে আসতে, প্রশ্ন করতে এবং তাদেরকে সত্যবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করতে নিষেধ করেছেন। অনুরূপভাবে আলোচ্য হাদিসগুলিতে এও প্রমাণিত হয় যে, গণক ও জাদুকররা কাফির। কেননা তারা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার দাবি করছে, যা কি না কুফুরি। তদুপরি তারা আল্লাহকে ছেড়ে জিনের সেবা ও ইবাদাঁতের মাধ্যমেই তাদের উদ্দেশ্য সাধন করছে। অথচ এ কাজও কুফুরি এবং আল্লাহর সঙ্গে শরিক করারই নামান্তর। যে ব্যক্তি তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবিকে সত্য প্রতিপন্ন করে সে ও তাদেরই অনুরূপ। আর যেসব ব্যক্তি এ বিষয়গুলি এমন লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে, যারা তা পরস্পর আদানপ্রদান করে থাকে, সে সব ব্যক্তির সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব লোক যাকে চিকিৎসা বলে ধারণা করে থাকে, তাকে মেনে নেওয়া ও গ্রহণ করা কোনো মুসলিমের জন্য জায়েজ নেই। যেমন বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ কিংবা জলে ইস্পাত চুবানো ইত্যাদি আরও অনেক কুসংস্কার যা তারা করে থাকে, তার কোনোটাই জায়েজ নয়। কেননা তা দৈবকর্ম চর্চা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। এসব ব্যাপারগুলোকে যারা মেনে নেয়, তারা মূলত এ লোকদেরকে তাদের বাতিল ও কুফুরি কাজে সহযোগিতা করল। অনুরূপভাবে কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য জ্যোতিষী ও দৈবজ্ঞানের দাবিদারদের কাছে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করা জায়েজ নেই যে, তার ছেলে কিংবা তার কোন আত্মীয় কাকে বিয়ে করবে? কিংবা স্বামী-স্ত্রী ও তাদের উভয়ের পরিবারে ভালবাসা ও মিল-মহব্বত হবে নাকি শত্রুতা ও দূরত্বের সৃষ্টি হবে ইত্যাদি। কেন-না এসব সে গায়েবি ও অদৃশ্য জ্ঞানেরই অন্তর্গত যা শুধু মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। সকল মুসলিম মনীষীদের সর্বসম্মত মতানুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ বৈধ। আর যে কোনো মুসলিম ব্যক্তিরই অধিকার রয়েছে যে, সে অভ্যন্তরীণ রোগের ডাক্তার কিংবা শৈল চিকিৎসক অথবা মানসিক রোগের ডাক্তার কিংবা অনুরূপ যে কারও কাছে যেতে পারে, যাতে তিনি তার রোগব্যাধি চিহ্নিত করে চিকিৎসাশাস্ত্রে তার জ্ঞান অনুযায়ী শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত পথ্য দ্বারা তার চিকিৎসা করেন। কেননা এটা সাধারণ বৈধ পন্থাগুলিরই অবলম্বনেরই অন্তর্গত। উপরন্তু এ ধরনের পন্থাবলম্বন আল্লাহর উপর নির্ভরতার পরিপন্থী নয়। কারণ আল্লাহ রোগ দিয়েছেন এবং সে রোগ নিরাময়ের ঔষধও বাতলে দিয়েছেন। যার জানার সে তা জেনেছে এবং যে জানেনি, এ পথ্য তার অজ্ঞাতই থেকে গেছে। অবশ্য আল্লাহ বান্দার উপর হারাম করেছেন এমন কোনো বস্তুকে তার রোগ নিরাময়ের উপায় নির্ধারণ করেননি। সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সেই সব গণক, জ্যোতিষী ও দৈবজ্ঞদের কাছে যাওয়া বৈধ নয়, যারা দাবি করে যে, তাদের কাছে অসুস্থ ব্যক্তির রোগ চিহ্নিত করার গায়েবি জ্ঞান আছে। অনুরূপ অসুস্থ ব্যক্তির জন্যও এসব গণক ও দৈবজ্ঞদের দেওয়া তথ্য ও সংবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা বৈধ নয়। কেননা তারা গায়েবি বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করেই এসব বলে থাকে কিংবা তারা তাদের ঈপ্সিত বিষয়ে সাহায্য নেওয়ার জন্য জিনদের হাজির করে থাকে। তার মানে এই নয় যে মুসলিমরা জ্যোতিষচর্চা করেন না। জ্যোতিষীদের চেম্বারে মুসলিম জাতকরাও গ্রহশান্তির জন্য আসেন। রত্ন ধারণও করেন। মুসলিম দেশে হয় কি না আমার জানা নেই। তবে ভারতে এক-আধজন মুসলিম জ্যোতিষী পাওয়া যায়। পিরবাবাদের আমি ভবিষ্যৎ বাণী শোনাতে দেখেছি। ধর্ম ধর্মের জায়গায় আছে, ব্যাবসা ব্যাবসার জায়গায়।