(১০) সুদূরের জন্য একটি ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারিত হয়ে আছে। এতদিন আমি অবশ্যই বেঁচে থাকব না, যাঁরা ভবিষ্যৎ বাণী শোনাচ্ছেন তাঁরাও বেঁচে থাকবেন না। ৩৭৯৭ সাল। ধ্বংস হবে পৃথিবী! অন্য গ্রহে বাসা বাঁধবে মানুষ। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি অবশ্য জনৈক ‘বাবা ভাঙা’-র। তাঁকে নাকি বলা হয় ‘এ যুগের নস্ত্রাদামুস’। ২০ বছর আগে তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু আইএস-এর উত্থান বা টুইন টাওয়ারের হামলার কথা নাকি তিনি বলে গিয়েছিলেন। বাবা ভাঙা যা বলে গিয়েছেন, তার মধ্যে থেকেই তুলে ধরা হল কয়েকটি। মিলিয়ে নিন।
(১) বারাক হুসেন ওবামাই হবেন আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট।
(২) ২০১৬ সালেই ইউরোপ শেষ হয়ে যাবে। রাসায়নিক অস্ত্রে ইউরোপকে শেষ করে দেবে সন্ত্রাসীরা।
(৩) ইউরোপ ছেয়ে ফেলবে মুসলিম জঙ্গিরা। আর এই সন্ত্রাসের সূত্রপাত হবে সিরিয়ায়।
(৪) ২০১৮ সালের মধ্যে সুপারপাওয়ার হিসাবে উত্থান হবে চিনের। পর্যন্ত হবে আমেরিকা।
(৫) ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা দূর হবে।
(৬) শুক্র গ্রহে বাসা বাঁধবে মানুষ।
(৭) ২০৪৫ সালের মধ্যে মেরু অঞ্চলের আইসক্যাপ গলে যাবে।
(৮) ২০৭৬ সালে কমিউনিজম ফিরবে পুরোদস্তুর।
(৯) ২১৩০ সালের মধ্যে জলের তলায় বসবাস শুরু করবে মানুষ।
(১০) ৩৭৯৭ সালে ধ্বংস হবে পৃথিবী। ততদিনে অবশ্য অন্য গ্রহে থাকতে শুরু করবে মানুষ। সত্য/মিথ্যার সাক্ষী থাকুন আপনি। সময় তো আছেই।
হাত দেখা বা হস্তরেখা বিচার সম্ভবত জ্যোতিষীবাবুদের মধ্যে সবচেয়ে জয়প্রিয়তম ব্যবস্থা। জাতকরাও কেউ হাত দেখতে জানে জানতে পারলে তার দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেন না। অবশ্য এই ‘হস্তরেখা বিচার’ পদ্ধতির পুষ্টিলাভ খুব বেশিদিনের কথা নয়। পঞচদশ শতকে হস্তরেখা বিদ্যার উপর কিছু পরিমাণ বিক্ষিপ্তভাবে লেখালেখি হলেও মূলগতভাবে এই বিদ্যার রমরমা শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীতে। মহাভারতের যুগেও অনুমান করেই ভবিষ্যৎ বাণী করা হত। শকুন্তলাকে দুর্বাসাও ভবিষ্যৎ বাণী দিয়েছিল, যা অভিশাপ বলেই বিদিত। দুর্বাসা জানতেন রাজা দুষ্যন্ত জন্ম-পরিচয়হীন শকুন্তলাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে না। করার কথাও নয়। কারণ একজন বনবাসীকে কিছুতেই রাজপরিবারে জায়গা দিতে পারে না। সামাজিক অবস্থান তো ভিন্ন মেরুতে।
যাই হোক, হাত দেখার মহিমাই অপরিসীম। বন্ধুমহলে বেশ কদর পাওয়া যায়। অফিসের বসকেও খুব সহজে কবজা করা যায় হাত দেখে পজিটিভ বাণী শুনিয়ে। বিনা মূলধনে বিনা পরিশ্রমে টু-পাইস কামানোর সুযোগ হাতছাড়া করা যায়! কী আছে হাতে? কী দেখা হয় হাতে? হাতে কী অতীত-বর্তমান ভবিষ্যৎ লেখা থাকে? জ্যোতিষীবাবুরা তো সেটাই বলে, হাতে লেখা থাকে! শুধু হাতেই নয়– কপাল, হাতের কবজি, শরীরের তিল, পায়ের রেখা সবেতেই নাকি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ লেখা থাকে। গতকাল এবং আগামীকাল, ভূত এবং ভবিষ্যৎ– যত গণ্ডগোল তো এখান থেকেই, আদিকাল থেকেই। ‘ভূত’ শব্দটি বস্তুত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হলেও ব্যঞ্জনা প্রায় কাছাকাছিই। একটি অর্থ। ‘অতীত’, অন্যটি হল ‘প্রেত-প্রতিনী’, ‘প্রেত-প্রতিনী’ তো যিনি অতীত বা মৃত হয়েছেন তার অশরীরী। আমরা ভূত জেনে অবাক হই, বর্তমান জেনে খুশি হই এবং ভবিষ্যৎ জেনে আতঙ্কিত হতে ভালোবাসি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না হলেও অতীত আমাদের মনে থাকে অনেকটাই, আমরা তাই জন্য স্মৃতিচারণ করতে পারি। আমার অতীত জানতে আমি জ্যোতিষবাবুর কাছে যাব কেন! জ্যোতিষীবাবুরা মানুষের সেই অতীতই বলে থাকেন, সেগুলি সকলের জন্য খুবই কমন (Common)। আপনার মনে হয় উনি আপনার ‘অতীত’ বলতে পারলেন। আপনি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকলেন, এই বুঝি অতীতে করা আপনার অপকর্মগুলিও বলে ফেলল! তবুও বারাবার জ্যোতিষীর কাছে যাই, গিয়ে একবার ঝালিয়ে নিই। আপনার মতে না মিললে সেই জ্যোতিষী খারাপ, অন্য ‘বিখ্যাত’ জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হবেন নিশ্চয়। আর মতে মিললে তো ভগবান– আপনি সব উজার করে দিতে রাজি হয়ে যান। বস্তুত সব জ্যোতিষীর মধ্যে ওই ‘মেলানোর’ পারদর্শিতা বা অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা থাকে না।
কীভাবে? বলব। আমি তো আমার কথা বলব, যুক্তিবাদীদের কথা বলব, বিজ্ঞানের কথা বলব। তার আগে জ্যোতিষীবাবুদের বক্তব্য শুনব না কি করে হবে?
জ্যোতিষীবাবুরা বলেন– “জ্যোতিষ একটি ঐশ্বরিক ব্যাপার। আসলে এটা কোন মত পোষণ করা বা বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। জ্যোতিষে এমন কিছু বিষয় আছে, যা চট করে দেখলে একেবারেই মন-গড়া, বা বানানো মনে হয়। অথচ সেগুলিই বাস্তবে খুব ভালো মতো কাজ করে বা ফল দেয়। যেমন, রাশিচক্রের বিন্যাসের (Arrangement) ব্যাপারটি বলা যেতে পারে। জ্যোতিষে ৯টি গ্রহ বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে আসল গ্রহ ৫টি– বুধ, শুক্র, মঙ্গল, শনি, এবং বৃহস্পতি। সূর্য ও চাঁদকেও ‘গ্রহ’ নামে ডাকা হয়। এছাড়া রাহু ও কেতু নামে দুটো অবস্থানগত বিন্দুকেও (Positional Points) গ্রহ ধরে মোট ৯টি ‘গ্রহ’ পাওয়া যায়। এদেরকে ‘নবগ্রহ’ বলা হয়। এই নবগ্রহের মধ্যে সূর্য ও চাঁদের অবশ্যই একটা আলাদা অবস্থান বা গুরুত্ব আছে। কেননা সূর্য আসলে গ্রহ নয়, বরং নক্ষত্র। সব গ্রহগুলির চেয়ে বহুগুণ বড়ো হওয়াতে এর একটা আলাদা প্রভাব আছে। সৌরজগতের সব গ্রহগুলি সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। তাছাড়া পৃথিবীতে দিন-রাত, ঋতু পরিবর্তন ইত্যাদিতে সূর্যের এমন প্রভাব আছে, যা অন্য কারও নেই। আবার চাঁদ গ্রহদের থেকে ছোটো হলেও, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে হওয়ার জন্য এর আলাদা এক রকম প্রভাব আছে, যা জোয়ারভাটা, মানুষের শরীরের বাত, আরও বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। সুতরাং সূর্য ও চাঁদের এমন একটা অবস্থান বা প্রভাব আছে, যা বুধ, শুক্র, শনি ইত্যাদির নেই। রাশিচক্রে ১২টি রাশির প্রত্যেকটি রাশি কোন না-কোন গ্রহের মালিকানাধীন। আপনার যে রাশিই হোক না-কেন, তার একটি মালিক বা অধিপতি (owner) আছে বলে রাশিচক্রের বইয়ে বা পত্রিকাতে পাবেন। রাহু কেতু অবস্থানগত বিন্দু, তাদের আসলে কোনো দৃশ্যমান কাঠামো (Physical Structure) নেই। তাই তারা সেভাবে কোনো রাশির মালিক নয়। বাকি ৭টা গ্রহ এই ১২টি রাশির মালিক। আবার, রাহু-কেতু বাদে এই ৭টা গ্রহ, সপ্তাহের ৭টা দিনেরও মালিক। এবং সেই সেই দিনে সেই সেই গ্রহের প্রভাব, বাস্তব জীবনে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। ১২টি রাশিকে কীভাবে ৭টি গ্রহের মধ্যে ভাগ করা যায়? প্রত্যেক গ্রহ ২টি করে রাশি পেলে রাশি দরকার ১৪টি, আবার ১টি করে হলে ৭টি গ্রহের ৭টি রাশি পাওয়ার পর আরও ৫টি থেকে যায়। তাহলে? জ্যোতিষে বিষয়টির সুরাহা করা হল এভাবে– সূর্য ও চাঁদ যেহেতু ৭টি গ্রহের মধ্যে একটু আলাদা (Special), এদেরকে ১২টি রাশি থেকে ১টি করে রাশি দেওয়া হোক (মোট ২টি)। আর বাকি থাকল ১০টা, এই ১০টা রাশি বাকি ৫টি গ্রহের মধ্যে ২টি করে ভাগ করে দেওয়া হোক। তাহলে সূর্য ও চাঁদ = ১ + ১ = ২, আর বাকি ৫টি গ্রহ ২টি করে = ৫ x ২ = ১০, মোট ২ + ১০ = ১২, মিলে গেল। বিষয়টি খুব সাধারণ, মনে হয় কোন একটা ঘরোয়া আলোচনায় ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। কিন্তু এটাই বাস্তব জীবনে খেটে যায়। কেননা এটাই জ্যোতিষের ভিত্তি, আর সব হিসাব-নিকাশ এর উপর ভিত্তি করেই করা হয়। তাই এটা ঠিক না-হলে, কোনো কিছুই মিলত না। এখন, রাশির বিন্যাস (Positioning/Arrangement) কীভাবে করা হবে? এটাও এমন একটা ব্যাপার, দেখলে মনে হবে কারও বানানো বা কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু এটাই বাস্তবে খেটে যায়। কীভাবে দৃশ্যমান ভৌত শরীর (physical body) -থাকায় রাহু-কেতুকে রাশির মালিকানা না-দেওয়া, এরপর বাকি ৭টি গ্রহের মধ্যে সূর্য ও চাঁদকে আলাদা বিবেচনা করে ১টি করে রাশি দিয়ে এরপর দু-পাশে একই গ্রহের ১টি করে রাশি বসিয়ে বসিয়ে সম্পূর্ণ রাশিচক্রটি (Zodiac) সাজানো বা বিন্যাস করা (Arrange) একেবারেই মানুষ বা অন্য কারও বানানো মনে হয়, যা খুব সাধারণ বিবেচনা নিয়ে (Casually) করা হয়েছে। এতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, ইত্যাদির মতো কোনো জটিলতা নেই। তাই দেখে যদিও মনগড়া মনে হয়, এই জিনিসটাই বাস্তবে মিলে যায়, বা খেটে যায়। এটা অবশ্যই একটা ঐশ্বরিকত্ব।” আধুনিক তত্ত্বের সঙ্গে জ্যোতিষের তত্ত্বকে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ইনি বাংলাদেশে বসবাসকারী বহু প্রচারিত এক জ্যোতিষীবাবু। এনার একটি ওয়েব সাইটও আছে বটে, জ্যোতিষের সমর্থনে প্রবন্ধ-ট্রবন্ধও লেখেন লেখকের নাম-পরিচয় ছাড়াই।