জ্যোতিষীর জ্যোতিষী সেরা জ্যোতিষী হলেন বি. ভি. রমন। ইনি ‘অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিন’ নামে পত্রিকাও করেন। এহেন জ্যোতিষীর কয়েকটি ঐতিহাসিক ভাগ্যনির্ণয় এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৭৯ সালে অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিনে লিখলেন, “জনতা দল সরকারের উপর এখন বৃহস্পতির কোনো ক্রোধ নেই। ফলে জনতা সরকার এবারের মতো টিকে যাবে।” দেশের রাজনীতির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরাই জানেন জনতা সরকারের কী হাল হয়েছিল। ১৯৮০ সালে লেখা হল, “তিন গ্রহের যা অবস্থান দেখছি তাতে দিল্লিতে পাকাঁপোক্ত সরকার হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।” সেবার ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতলেন। তাঁর দল ব্যাপক ফল করল। সরকার হল পাকাঁপোক্তই। রাজনীতির এলেম না-থাকলে এরকম ভুলভাল ভবিষ্যৎ বাণীই হয়। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের ভবিষ্যৎ কী যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বিনা জ্যোতিষ গণনায় বলে দেওয়া যায়– “২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলই দ্বিতীয়বার সরকার গড়বে, কোনো অঘটন ছাড়াই। আসন সংখ্যা গতবারের থেকে বাড়ার সম্ভাবনা।” এটা বলার জন্য জ্যোতিষবিদ্যা-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান জানার প্রয়োজন নেই। এমনকি এও বলা যায় –“আগামী লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির মসনদে বিজেপি সরকারের দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করার সম্ভাবনা, যদি কোনো অঘটন না ঘটে।” বলা যায়– “আগামী বছর অতি বর্ষণের সম্ভাবনা। মুম্বাই, কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হতে পারে। আগামী বছর বেশ কিছু নক্ষত্রপতনের যোগ আছে” ইত্যাদি। ফললে নিশ্চয় আমার পসার বাড়বে, না ফললে কে মনে রাখবে! মানুষের ক্ষেত্রেও প্রায় ৮০% মিলিয়ে দেওয়া সম্ভব বিনা জ্যোতিষবিদ্যায়। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা আছে। যে ভবিষ্যদ্বাণীটি আমি উল্লেখ করলাম, সেটিতে তথাকথিত কোনো অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ক্যালকুলেশন নেই, আছে পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন। এইভাবে অনেক কিছুরই ক্যালকুলেশন করে বলা সম্ভব হতে পারে। তার জন্য জ্যোতিষ, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতিষ-গণনার প্রয়োজন পড়বে না। তবে মিলতে পারে, নাও মিলতে পারে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন–”যেটা মেলে সেটাই বিশ্বাস করি। আর যেটা মেলে না সেগুলি ভুলে যাই।” এ প্রসঙ্গে আরও একটু বলতে পারি। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের জন্য তাঁর বাড়িতে একটা কোষ্ঠী করা হয়েছিল। সেই কোষ্ঠীতে বলা হয়েছিল– মঙ্গলের যা অবস্থান, তাতে সত্যেন্দ্রনাথের পড়াশোনা হবে না। কোষ্ঠীকে উড়িয়ে দিয়ে হিন্দু স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন। এই মহাবিশ্বের মৌলকণা তাঁর নামেই ‘বোসন’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পরের ঘটনা তো ইতিহাস, সবাই জানেন। সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় বলেছেন– “জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনার উপর কিছুমাত্র বিশ্বাস করিবে না। আমি উহার অনেক পরীক্ষা করিয়া এক্ষণে ইহাতে বিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়াছি।” একদা জ্যোতিষী বিশ্বাসী বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সংগ্রহের সমস্ত জ্যোতিষ বিষয়ক বইপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেন।
জ্যোতিষীবাবুদের ভবিষ্যত বাণী যে বহুবার মিথ্যা হয়েছে তার ঝুড়ি ঝুড়ি প্রমাণ আছে। মানুষ সেসব ভুলে যাবে কেন?! জ্যোতিষীবাবুরা অনেক সময় অনেক প্রমাণ-ট্রমাণ দিয়ে আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে আসলেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যে যত যুক্তি দিক, আর না-দিক– সত্যি কিন্তু পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা জ্যোতিষীবাবুরা বাণী না-ছাড়লেও হবে। এখন এমন দশটি ভবিষ্যৎ বাণীর কথা বলব যেগুলি বিশ্বজুড়ে আতঙ্কিত এবং আলোড়িত হয়েছে, অথচ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে।
(১) অপ্রামাণ্য রচনা (The Apocrypha), এই ভবিষ্যৎ বাণীটি করা হয়েছিল ১০০০ সালে। ইঞ্জিল শরিফের কয়েকটা লাইনের উৎস ধরে সবার মধ্যে আতঙ্ক ভাইরাল হয়ে যায় যে, ঈসার মৃত্যুর পর এক প্রজন্ম পরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কী ছিল ইঞ্জিল শরিফের সেই লাইনটি?– “Christ would be back in generation and that the genetation shall not pass.” opette, “জিশু আবার ফিরে আসবেন আগামী প্রজন্মে। এবং সেই প্রজন্ম পরিত্রাণ পাবে না“। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী চার্চ থেকে অর্থের বিনিময়ে মানুষেরা নিজেদের জন্য স্বর্গে জমি কিনে রাখতে পারতেন এবং মানুষজন সংশ্লিষ্ট চার্চে অর্থ প্রদান পাপ থেকে মুক্তি পেলেন বলে বিশ্বাস করতেন। যেহেতু সেসময় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে, সেইহেতু অনেকেই নিজেদের সর্বস্ব সম্পদ বিক্রিবাটা করে চার্চে অনুদান দিয়ে পাপমুক্তির হিড়িক পড়ে গেল। সেই সুযোগে এক লপ্তে চার্চগুলিতে কোটি কোটি টাকা রোজগার হয়েছিল, বলাই বাহুল্য। যেহেতু সেসময়ে ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার সহজলভ্য ছিল না, তাই সাধারণ মানুষ ধ্বংসের দিন হিসাবের জন্য মহান চার্চের উপরই নির্ভর করত। তখনকার দিনে পোপ/পাদরিদের বাণী বা ঘোষণাই ছিল শেষ কথা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পৃথিবী ধ্বংসের ভবিষ্যৎ বাণী। শুনিয়ে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!