(৪) পুব আকাশে রাশি উদয় হয়–এই বিষয়টি এক্কেবারেই আপেক্ষিক। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সূর্যোদয়কাল বিভিন্ন হওয়ার ফলে পুবদিকে উদিত রাশিটি ভিন্ন হবে। ফলে একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো জাতকের লগ্ন বিভিন্ন রকমই হবে, কোষ্ঠীও হবে বিভিন্ন। অতএব একই সময়ে জন্মানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা জাতকের আলাদা লগ্নফল এবং কোষ্ঠীচক্র হবে না, তাই তো? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।
(৫) জ্যোতিষীদের যে শাস্ত্র, তা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে মেনে চলে। অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য সহ সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্ররা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তত্ত্ব তো অচল তত্ত্ব, আস্তাকুড়ে তার ঠিকানা। এই ধরনের তত্ত্ব কে. সি. পালের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে পারেন, যারা ভাঙা রেকর্ডের মতো এখনও চলেছেন ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’। এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলতে অসুবিধা আছে। ভুল হবে রাশি-গ্রহের অবস্থান। সঠিক হবে না রাশিচক্র, কোষ্ঠী-ঠিকুজি। এ তত্ত্ব সঠিক হলে গ্রহ-উপগ্রহগুলিতে মহাকাশযান কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো সম্ভব হত না। ওই তত্ত্ব ভুল, তাই জ্যোতিষ ভুল। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।
(৬) কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীবাবুরা যোটক বিচার করে। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীদের রাজযোটক হলে দাম্পত্যজীবন বড়োই সুখময় হয়!!! যোটক বিচার কাকে বলে? এককথায় –“বিবাহের পূর্বে পাত্র এবং পাত্রীর পরস্পরের জন্মরাশ্যাদি থেকে যে শুভাশুভ বিচার করা হয়, তাকে রাজযোটক বলে”। এই বিচার আট প্রকার, অর্থাৎ আট প্রকারের কূট। কূট’ কথাটির অর্থ জটিল। জ্যোতিষীবাবুরা প্রবল কূট বলে দু-হাতেই আট প্রকারের কূট’ সামাল দিতে পারেন। এই কূটগুলি হল– বর্ণকূট, বশ্যকূট, তারাকূট, যোনিকূট, গ্ৰহমৈত্রীকূট, গণমৈত্রীকূট, রাশিকূট এবং ত্রিনাড়িকূট। এদের আবার ‘গুণ’ আছে। বর্ণকূট’ থেকে ‘ত্রিনাড়িকূট’ পর্যন্ত গুণ হবে ১,২,৩ ইত্যাদি। মোট নম্বর ৩৬-এর মধ্যে ১৮ নম্বর পেতেই হবে, আর তা না-হলে ডাহা ফেল। যদি ৩০-এর উপর নম্বর হয় তাহলে লেটার মার্কস হবে। একটু ‘যোনিকূট’ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক –যোনি চোদ্দ প্রকার। দুটি করে নক্ষত্র নিয়ে এক-একটি যোনি। অভিজিৎ নক্ষত্রকে ধরে নক্ষত্রের সংখ্যা ২৮। অবশ্য সবকটি যোনিই ইতর-যোনি, অর্থাৎ ঘোড়াযযানি, মোষযযানি, বাঘযোনি, সিংহযোনি, হাতিযোনি, কুকুরযোনি, বেড়ালযোনি, ইঁদুরযোনি, বানরযোনি ইত্যাদি। না, মানুষের জন্য মনুষ্যযোনি নেই। তামাম মনুষ্যকুল ইতর-যোনির অংশ। ছাগল, কুমির, হাঙ্গর, গোরিলা, গোসাপ, শিম্পাঞ্জি, টিকটিকিদের কি যোনি নেই!
আমার বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিস পাত্রের কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বড়ই বিপদে পড়ে গেল আমার অভিভাবক। কারণ আমার কোনো কোষ্ঠী-ঠিকুজি ছিল না। অতএব জ্যোতিষে শরণাপন্ন। জ্যোতিষীকে বলে আমার একটা ‘রাজযোটক’-এ মিল হয়েছে এমন একটা কিছু করিয়ে আনা হল। কেল্লা ফতে, বিয়ে পাক্কা। আদতে আমার রাশি, লগ্ন, কোষ্ঠী কিছুই নেই– তার আবার রাজযোটক! আমার ১২ বছরের সংসার দিব্য চলছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ো মেয়ের বিয়ে ছিল রাজযোটক। ভাটপাড়ার জনৈক জ্যোতিষী মেয়ে আর হবু জামাইয়ের কোষ্ঠীবিচার করে সেটাই বলেছিলেন। রাজযোটকের বিয়ে, তা সত্ত্বেও বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ো মেয়ে বিধবা হয়ে যান। এরকম হাজার হাজার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা যায়, যেখানে রাজযোটক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে অকালে নষ্ট হয়ে গেছে। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।
(৭) একদা, মানে দেড়শো বছর আগে পর্যন্ত জ্যোতিষীবাবুরা বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকলে বাল্যবিবাহের নিদান দিতেন। তাই ওই সময় প্রায় সকল মেয়েদেরই বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকার ফলে বাল্যবিবাহ হত। ১৯৯৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯৯৯’ চালু হওয়ার পর থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে গেল। বলবান সপ্তমপতি গেল কোথায়? কেন্দ্রের কোণে আর থাকেন না? গেছে। ভুল। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকবেন।
“পৃথিবীর ১০জন সেরা মনীষীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের দেখা সবচেয়ে অপদার্থ জিনিসটিকে নিয়ে আসতে বলুন। দেখবেন, সবাই একজন করে জ্যোতিষীকে ধরে এনেছেন।” –বলেছেন গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট। না-হলে কয়েকশো কোটি বছর সৃষ্ট গ্রহ-নক্ষত্রকে দিয়ে মানুষের ভাগ্য নির্ণয় করে! মানুষের সৃষ্টি তো কয়েকশো কোটি বছর নয়!!! বর্তমানে সূর্যের বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর। চন্দ্র বা চাঁদের বয়স পৃথিবীর বয়সের প্রায় সমান, যা প্রায় ৪.৬ কোটি বছর। পৃথিবীতে প্রাপ্ত উল্কার বয়স ৪.৩ কোটি থেকে ৫ কোটি। মহাবিশ্বে এরকম ব্রহ্মাণ্ডের সংখ্যা কম নয়। এখনও পর্যন্ত ১০০টি ব্রহ্মাণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের ব্রহ্মাণ্ড ছাড়া খালি চোখে আর মাত্র ৩টি ব্রহ্মাণ্ড দেখা সম্ভব। এই ৩টির মধ্যে ২টি দক্ষিণ গোলার্ধে, আর-একটি মাত্র উত্তর গোলার্ধে। ২০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত শেষের ব্রহ্মাণ্ডটির নাম দেওয়া হয়েছে অ্যানড্রোমিডা (Andromeda)। একটি ব্ৰহ্মাণ্ড থেকে আর-একটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যবর্তী অংশের নাম ‘আন্তব্রহ্মাণ্ড মহাকাশ’। এই শতাধিক ব্ৰহ্মাণ্ড ও আন্তর্বহ্মাণ্ড মহাকাশ নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। নানা পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, ব্রহ্মাণ্ড জোটবদ্ধ অবস্থায় আছে। প্রতিটি ব্ৰহ্মাণ্ড জোট অপর প্রতিটি জোট থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেগও বৃদ্ধি পায়। ব্রহ্মাণ্ডের এহেন অস্থির গ্রহ-নক্ষত্র নিয়েই জ্যোতিষীবাবুদের কারবার। জ্যোতিষীবাবুরা এখানেই থেমে থাকেননি –তাঁরা রাজা-উজির, জীবজন্তু, জীবজন্তু, পশুপাখি, বৃক্ষলতা, পাহাড়-পর্বত– এমনকি ভারতের ভাগ্য, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যও বলে দেওয়ার সাহস রাখে –আবার দিল্লির সিংহাসনে কে বসবেন, পশ্চিমবঙ্গের মসনদের কে উপবেশন করবেন তাও বলে থাকেন –অনেকটা সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না কায়দায়– যদিও এ যাবৎকাল পর্যন্ত সবই ভুলভাল বলেছেন। জ্যোতিষীবাবুরা জানেন লাগলে রাতারাতি বিখ্যাত, না-লাগলে কেউ ফাঁসি তো দূরের কথা, কেউ কৈফিয়তই নেবে না।