জ্যোতিষীদের ভাগ্যগননার আর-একটি বড় উপাদান হল গ্রহ ও তাদের অবস্থান। জ্যোতিষ মতে গ্রহ-নক্ষত্রদের সময় ভেদে অবস্থানের উপরেই নাকি অর্থপ্রাপ্তি, ব্যাবসার লাভ-ক্ষতি, মামলা-মোকদ্দমায় হারা-জেতা, সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনা, স্বামীর পরস্ত্রীতে অনাসক্ত হওয়া, বিদেশ গমন, দুরারোগ্য অসুখ নিরাময়, প্রেমে জয়ী হওয়া, না-হওয়া বিয়ে হওয়া, পরীক্ষায় পাশ/ফেল ছাড়াও ইহ জাগতিক সকল কর্মই নির্ভর করে। তাহলে এখন খালি চোখে তাদের দাবিগুলির আসড়তাটা স্পষ্ট হয়। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রহের সংখ্যা হাজারেরও উপরে। আর সেখানে জ্যোতিষীদের গণনায় আছে শুধুমাত্র প্রাচীন পৃথিবীর আবিষ্কৃত সেই ৫টি গ্রহ। আর ইউরেনাস ও নেপচুনকে তাদের এই গণনায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাহু কেতু নামে দুটি কাল্পনিক গ্রহকে তাদের গণনায় পাওয়া যায়, সে তো আগেই বলেছি। মহাবিশ্বের এত গ্রহের মাঝে জ্যোতিষীরা গ্রহ স্বল্পতায় পরে সূর্যকে একটি গ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করে! বাস্তবিক অর্থে গ্রহনক্ষত্রগুলির কোনো শক্তি বা বলের এমন কোনো প্রভাবই নেই, যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর পৃথিবীর উপর যদি কোনো বলের প্রভাব থেকে থাকে, তা হল মহাকর্ষীয় বল। তবে গ্রহনক্ষত্রগুলি পৃথিবী থেকে এত দূরে যে তারা পৃথিবীর উপর মহাকর্ষীয় বা অভিকর্ষজনিত যে বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পরিমাণ অতি নগণ্য। তাই কারও জন্মমুহূর্তে গ্রহনক্ষত্রের আকর্ষণ বলের ক্রিয়া জন্মগ্রহণকারীর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনটি ভাবার কোনো যুক্তি নেই। প্রাচীনকালে মানুষ আকাশের বিভিন্ন অংশের এলোমেলো নক্ষত্রগুলির মাঝে তাদের ঘটমান জীবনের পরিচিত বিষয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজ করত বলেই কোনো নক্ষত্রমণ্ডলকে মেষের মতো আবার কোনো নক্ষত্রমণ্ডলকে কন্যা ইত্যাদি রূপে কল্পনা করেছিল। তাই বর্তমান সময়ে নক্ষত্রমণ্ডলগুলির নাম ও কল্পিত চিত্রগুলি তাদের মতোই রয়ে গিয়েছে। অবশ্য অন্য কিছু খুঁজেও পেতে পারি।
বাকি রইল লগ্ন। প্রতিটি লগ্নের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জ্যোতিষের বইগুলিতে অনেক বিস্তৃত ভাবে লেখা আছে। কোষ্ঠী বিচারের ক্ষেত্রে জ্যোতিষীরা লগ্ননির্ণয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। জ্যোতিষীদের মতে বারোটি পরপর পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় এবং ক্রমাগত পশ্চিমগামী হয়ে অবশেষে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়। আসলে পৃথিবীর আবর্তনের জন্যই এরকম মনে হয়। যেহেতু পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার আবর্তন সম্পূর্ণ করে। সেই কারণেই পূর্বদিকে এক-একটি রাশির স্থায়িত্বকাল ২ ঘণ্টা। সকাল ৬ টায় পূর্বদিকে যদি মেষ রাশি উদয় হয় তবে সেটি ৮ টা পর্যন্ত থাকবে, ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত পূর্বদিকে থাকবে বৃষরাশি, ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত পূর্বদিকে থাকবে মিথুন রাশি– এইভাবে দুই ঘণ্টা অন্তর একটি করে রাশি মিলবে, মোট ১২ রাশি। জ্যোতিষ মতে, বৈশাখ মাস থেকে শুরু করে চৈত্রমাস পর্যন্ত সূর্যোদয় মেষ থেকে শুরু করে মীন রাশিতে হবে। যেটি দাঁড়াল– বৈশাখ মাসে সূর্যোদয়ের সময় পূর্বদিকে থাকবে মেষ রাশি, জ্যৈষ্ঠ মাসে সূর্যোদয়ের সময় পূর্বদিকে বৃষ রাশি থাকবে ইত্যাদি। জাতকের জন্মের সময় যে রাশিটি থাকে, সেটিই হল জাতকের লগ্ন, জন্মলগ্ন। তবে এগুলি যে সবার ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে মিলবে এমন কোনো কথা নয়। গ্রহের বল ও অবস্থান অনুযায়ী বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হতে পারে বলে জ্যোতিষীরা বলে থাকেন। তাই মিলতেও পারে, আবার নাও মিলতে পারে। কারণ কোনো জাতকের চেহারা বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু লগ্ন কোন রাশিতে তার উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন গ্রহের বল ও অবস্থানের উপর সেটা অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলে জ্যোতিষীরা মনে করেন। বস্তুত এই নক্ষত্র, রাশি, মাসই হল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিষয়-আশয়। আর জ্যোতিষীরা এইসব গ্রহনক্ষত্র দিয়ে ছলনার কাজে লাগান, প্রতারণার কাজে লাগান, বুজরুকির কাজে লাগান। মানুষজনদের মাথা মোড়াতে সুবিধা হয়। বোঝাতে চায় –দেখো, আমরা কেমন বিজ্ঞানের উপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যদ্রষ্টা। প্রতারণার অভিযোগে চিটফান্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হলে জ্যোতিষীদের গ্রেফতার করা হবে না কেন?
জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ, নক্ষত্র, রাশি, লগ্নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
(১) ১৮ ডিগ্রির এক টুকরো আকাশে যদি ১২ টি রাশি থাকে, তাহলে ৩৬০ ডিগ্রি আকাশে ডিগ্রির আকাশে কত লক্ষ রাশি থাকতে পারে ভাবুন। তবে তো খুব ভয়ানক ব্যাপার, এত লক্ষ লক্ষ রাশির প্রভাব হিসাবে উচিত নয়? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।
(২) জন্মকালে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে সেটিই জাতকের রাশি বলা হয়। শুধু চন্দ্র কেন, সৌরজগতে তো আরও অসংখ্য গ্রহ আছে উপগ্রহ আছে –সেগুলি বিচার্য নয় কেন? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।
(৩) জাতকের জন্মসময় কোনটি? এটা বড় গোলমেলে ব্যাপার! কেউ মনে মনে করেন মাতৃজঠরে জ্বণের প্রথম দিন, কেউ মনে করেন মাতৃজঠরে থাকাকালীন যেদিন শরীরে প্রাণসঞ্চার হয়, কেউ মনে করেন যেদিন শিশু মাতৃগর্ভ ত্যাগ বেরিয়ে আসে, আবার কেউ মনে করেন শিশুর নাড়ি কাটার সময়, কেউ আবার এত ঝামেলায় না-গিয়ে চিকিৎসকের দেওয়া সার্টিফিকেটের জন্মসময় গ্রাহ্য করে –এক্ষেত্রে আবার সংশয়, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কর্মীরা যে সময় নথিভুক্ত করেছেন সেটা কতটা অথেনটিক! যাই হোক, জ্যোতিষীবাবুরা কোন জন্মসময় বিচার করে জাতকের কোষ্ঠী বিশ্লেষণ করবেন? ভিন্ন ভিন্ন। সময়কে জন্মসময় ধরলে ভিন্ন কোষ্ঠী বিচার হবে না? হবেই তো। রাশির অবস্থান পালটালে নির্ণয়ও পালটাতে বাধ্য। এক্ষেত্রে অবশ্য জ্যোতিষীবাবুরা বলেন, লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকাল ব্যতীত লগ্ন-মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের সন্নিবেশের এমন কিছু তারতম্য হয় না, ফলে রাশি পালটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ও মা, সে কি কথা! যদি জমজ সন্তান হয়? তাদের কোষ্ঠীবিচার তো একই হবে। মানে তারা একই সময়ে পটি করতে যাবে, একই শিক্ষকের কাছে পড়বে, একইরকম বিদ্বান হবেন, একই ক্লাসে পড়া শেষ করবে, একই জায়গায় একই চাকরি করবে, একই মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করবে, একই দিনে একই সময়ে একই কারণে মরবে –তাই-ই হবে, জ্যোতিষ বিজ্ঞান হলে। হয় কী? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মানোর পরপরই একটি সন্তান মারা যায়। তাহলে একই লগ্ন, একই গ্রহস্থান, একই রাশিচক্র হওয়া সত্ত্বেও দুইজন জাতকের আয়ুষ্কাল দুই রকমের হবে কেন? তাহলে কী পৃথিবীর সকল জমজ জাতকই লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকালে জন্ম নেয়? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? অবশ্যই নিরুত্তর থাকেন।